Darjeeling And Joshimath: গ্রামের বাড়িতে চিড়, শহরে বহুতলের ভিড়! দার্জিলিংও কি জোশীমঠ হওয়ার অপেক্ষায়?

TV9 Bangla Digital | Edited By: সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়

Jan 18, 2023 | 1:40 PM

২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের বন্যায় বিপদসঙ্কেত শুনিয়েছিল প্রকৃতি। কেউ শিক্ষা নেয়নি। না প্রশাসন, না মানুষ। এ বার কি জোশীমঠকে দেখে শিখবে আমাদের শৈলশহর, হামরো দার্জিলিং?

Darjeeling And Joshimath: গ্রামের বাড়িতে চিড়, শহরে বহুতলের ভিড়! দার্জিলিংও কি জোশীমঠ হওয়ার অপেক্ষায়?
আজ জোশীমঠ, কাল দার্জিলিং? অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।

Follow Us

কমলেশ চৌধুরী

আজ জোশীমঠ, কাল দার্জিলিং?
প্রশ্নটা কেন তুলছি, তার কি আর ভূমিকা দরকার? চিড় ও ফাটলের জাঁতাকলে বাতিলের তালিকায় যেতে বসেছে জোশীমঠ। বসে যাচ্ছে উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি-শহর। বৃষ্টিতে ধস বাড়লে আরও বড় বিপদের আশঙ্কা। বসতি-বাণিজ্য-বর্ডার… একধাক্কায় তিন ক্ষেত্রকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বিপর্যয়। এ বিপর্যয় যে প্রাকৃতিক নয়, তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের বন্যায় বিপদসঙ্কেত শুনিয়েছিল প্রকৃতি। কেউ শিক্ষা নেয়নি। না প্রশাসন, না মানুষ। এ বার কি জোশীমঠকে দেখে শিখবে আমাদের শৈলশহর, হামরো দার্জিলিং?

উত্তরের খোঁজে, অন্তর্তদন্ত করতে দু’দিনের জন্য পাহাড়ে পাড়ি দিয়েছিল TV9 বাংলা। সঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলা বিশেষজ্ঞ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয়ের অধ্যাপক গুপীনাথ ভাণ্ডারি। যা চোখে পড়ল, তা ভয়ানক। মোদ্দা কথা, বিপর্যয়ের বোমার সলতে পাকানোই আছে, আগুন লাগানোটাই যা বাকি! প্রকৃতি খেপে উঠলে ‘জোশীমঠ’ হতে সময় লাগবে না।

যাত্রার শুরু সেবকে। বিপর্যয়ের বীজ পোঁতার কাজও কি সেবকেই শুরু? হেঁয়ালির মধ্যে রাখব না। সোজা কথায় বলি। সেবকে বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে। রংপো পর্যন্ত ৪৪.৯৬ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন হবে। যার ৮৬ শতাংশ অর্থাত্‍ ৩৮.৬ কিলোমিটারই টানেল। রেলের মানচিত্রে জুড়ে যাবে সিকিম। যাত্রার সময় কমবে। নিশ্চিত ভাবেই উন্নয়ন। কিন্তু প্রকৃতির উপর তার প্রভাব পড়বে না?

আলবাত পড়বে। বলা ভাল, পড়ছে। তেমনই অভিযোগ কার্শিয়াংয়ের কর্মঠ গ্রামের বাসিন্দাদের। সেবক থেকে যে রাস্তা সিকিম গিয়েছে, সেই ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর কালিঝোরা। কালিঝোরা থেকে ২৯ মাইল—গোটা রাস্তার একটা বড় অংশ ধসপ্রবণ। হিলকার্ট রোডের তিনধারিয়া বা পাগলাঝোরার মতোই। প্রতি বছর বর্ষায় একাধিক দিন ধসে বন্ধ থাকে রাস্তা। বিপদে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পর্যটক। কালিঝোরার একদিকে তিস্তা, তিস্তার উপর তৈরি জলাধার। ঠিক অন্য দিকে, পাহাড় ফাটিয়ে তৈরি হচ্ছে টানেল। রেলের সুড়ঙ্গ। এই কালিঝোরা থেকেই একটি রাস্তা সোজা উঠে গিয়েছে লাটপাঞ্চোরের দিকে। পাখিপ্রেমীদের পছন্দের স্পট। এই রাস্তায় কিছুটা এগোলেই কর্মঠ গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দা দেবকী রাই, সুমন রাই বাড়ির দেওয়ালে চিড় দেখিয়ে সরাসরিই বলছেন, ‘‘আগে ফাটল ছিল না। টানেল তৈরির কাজ শুরুর পর থেকেই দেওয়ালে দেওয়ালে ফাটল দেখা যাচ্ছে।’’ গ্রামের বাসিন্দা রাজেন থাপার বাড়ির উঠোনেও মাঝ বরাবর লম্বা ফাটল। রাজেন বলছেন, ‘‘এই অঞ্চলের পাহাড় ধসপ্রবণ। কিন্তু টানেল তৈরির পর থেকে ধস বাড়ছে। রেলের উচিত, গ্রামে-গ্রামে এসে সমীক্ষা করা।’’

ফাটল কেন, তা সমীক্ষা করলেই স্পষ্ট হবে। কিন্তু টানেল-যোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন না অধ্যাপক ভাণ্ডারি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের শিক্ষক চিড় পরীক্ষা করে বলছেন, ‘‘টানেল তৈরির সময় ডিনামাইট ফাটাতে হয়। সেই বিস্ফোরণে এমন ফাটল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, এই অঞ্চলে মাটি বসে যাওয়ার প্রবণতা আছে। মাটি কখনও একযোগে বসে না। কোথাও কম বসে, কোথাও বেশি বসে। সেই কারণেই উপরের কাঠামোর চিড় বা ফাটল ধরে। এই চিড়গুলি জোশীমঠের তুলনায় কিছুই নয়। তবে মনে রাখতে হবে, জোশীমঠের ফাটলও শুরুতে সরু ছিল, যাকে বলে হেয়ারলাইন ক্র্যাক। পরে তা বেড়েছে।’’ অর্থাত্‍, প্রশাসনিক অবহেলার অগোচরে ফাটল চওড়া হয়েছে জোশীমঠের। কপালও ফেটেছে পাহাড়বাসীর। চারধামে চার লেনের হাইওয়ে থেকে এনটিপিসি-র জলবিদ্যুত্‍ প্রকল্প, টানেল—এহেন লাগামছাড়া উন্নয়নকেই জোশীমঠের বিপর্যয়ের পিছনে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা।

সেবক-রংপো রেললাইনও কি তেমন বিপদের কারণ হতে দাঁড়াতে পারে? অধ্যাপক ভাণ্ডারির সাবধানবাণী, ‘‘আশা করা যায়, রেল সমস্ত নিয়ম মেনেই টানেল তৈরি করছে। কিন্তু তার পরও যখন অভিযোগ উঠছে, তখন ফাটল খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ, টানেলে যখন ট্রেন ছুটবে, সে সময়ও মাটি কাঁপবে। তার কোনও প্রভাব এই তল্লাটের বাড়ি, ঘরদোরে পড়বে কি না, তার উত্তর জানা জরুরি।’’

প্রশ্ন অনেক। তাই কর্মঠে দাঁড়িয়ে থাকলেই চলবে না। গাড়ি ছুটল দার্জিলিংয়ের দিকে। তিস্তা বাজার হয়ে পেশক রোড, জোড়বাংলো, ঘুম হয়ে সোজা দার্জিলিং শহর। অঞ্জন দত্ত গেয়েছিলেন, ‘খাদের ধারের রেলিংটা।’ উপত্যকার দিকে একঝলক তাকালে মনে হয়, খাদের ধারের গোটা দার্জিলিংটা। পর দিন সকাল থেকে বিকেল, অলিগলি ঘুরে যা চোখে পড়ল, বিশেষণ সেই একটাই: ভয়ানক।

কেন ভয়ানক?

বাড়ির গায়ে বাড়ি। উঁচু-উঁচু বাড়ি। সমতলে যা করা যায়, তা কি পাহাড়েও করা যায়? পরিবেশবিদরা বলবেন, না। অসাধু বিল্ডাররা বলবেন, হ্যাঁ। তাতে রাজনৈতিক নেতাদেরও সায় থাকবে। দার্জিলিং পুরসভা ঘুমিয়ে আছে বলেই তো বহুতলের বাড়াবাড়ি পাহাড় জুড়ে। অথচ, পুর নিয়ম অনুযায়ী ৩৬-৩৭ ফুটের বেশি উচ্চতা হওয়ার কথা নয়। অর্থাত্‍, বড়জোর চারতলা বাড়ি। কী দেখলাম আমরা? কয়েকটা উদাহরণ দিই। ঘড়িমিনারের কাছে, কেভেন্টার্সের প্রায় উল্টো দিকে যে বহুতল, তার উচ্চতা কত? সাত তলা মানে অন্তত ৭০ ফুট। ম্যালের আশপাশে এরকম পাঁচতলা, ছ’তলা, সাত তলা বাড়ির ছড়াছড়ি। আমরা খুঁজে বের করেছি আরও উঁচু বাড়ি। তবে এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার উচ্চতা বোঝা মুশকিল। লাল ধিকি এলাকার বহুতলটি একদিক থেকে দেখলে মনে হবে, ছ’তলা। পিছনের রাস্তায় গিয়ে দেখলে মনে হবে, পাঁচ তলা হোটেল। আদতে পাহাড়ের ঢালে তৈরি হওয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয়। কিন্তু একটু উঁচু ঢালে উঠলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, হোটেল আসলে ৬তলা বাড়ির উপর। সবটা মিলিয়ে ১১তলা।

এত উঁচু বাড়ি কী ভাবে দাঁড়িয়ে দার্জিলিংয়ে?

বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই অচলায়তনই ভাঙতে গিয়েছিলেন হামরো পার্টির নেতা, গ্লেনারিজের মালিক অজয় এডওয়ার্ডস। মার্চে দার্জিলিং পুরসভার ক্ষমতা দখলের পরই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, বেআইনি নির্মাণ বরদাস্ত নয়। তাঁর নির্দেশে ভাঙার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। সদ্য দার্জিলিং পুরসভা হাতছাড়া হয়েছে হামরো পার্টির। কেন হাতছাড়া হল? বিস্ফোরক অজয়। তাঁর সাফ কথা, ‘‘আমাকে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, বেআইনি নির্মাণ বরদাস্ত করবে না। অথচ, তৃণমূল কাউন্সিলররাই বেআইনি নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি বাধা দেওয়াতেই ওঁদের রোষে পড়ে যাই। সব বিল্ডাররা টাকা দিয়ে, আমাদের কাউন্সিলরদের লক্ষ-লক্ষ টাকায় কিনে নিয়েছে।’’ তবে অজয় আশাবাদী, ‘‘বিরোধী দল হিসেবে থাকব। বেআইনি নির্মাণ ভাঙার পক্ষে সওয়াল করে যাব। এর সঙ্গে আমাদের পাহাড়ের ভবিষ্যত্‍ জড়িয়ে।’’

ভবিষ্যত্‍ কতটা অন্ধকার? দার্জিলিংয়ের রাস্তায় ঘুরে আঁতকে উঠছেন অধ্যাপক ভাণ্ডারি। গান্ধী রোডে, হোটেল সিনক্লেয়ার্সের কাছে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। গান্ধী রোড থেকে টেরেসা রোড পর্যন্ত ছড়ানো বহুতল উঠছে। নীচে পার্কিং, উপরে হোটেল। ১০০ ফুট ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার থাকবে না। দিনভর আর্থ মুভার আর ডাম্পারের শাসন চলছে সাইটে। অধ্যাপক ভাণ্ডারি বলছেন, ‘‘দার্জিলিং বহু বছর আগের দার্জিলিংয়ের মতো থাকলেই ভালো হত। এত উঁচু বাড়ির লোড নেওয়ার ক্ষমতা পাহাড়ের ঢালের নেই। এরকম চলতে থাকলেই ধসের আশঙ্কা বাড়ে।’’

ছবি কথা বলে। দার্জিলিংয়েও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরনো আমলের যা কাঠামো, সবই হাল্কা। মানে লাইট ওয়েট স্ট্রাকচার। যার ভার সহজেই পাহাড় নিতে পারে। পাঠকের বোঝার সুবিধের জন্য কয়েকটা উদাহরণ টানা যেতে পারে। যেমন, গ্লেনারিজ়। যেমন, দ্য এলগিন হোটেল বা ম্যালের চ্যালেট হোটেল। যেমন, দাস স্টুডিও বা তার পাশের কালিম্পং আর্ট গ্যালারি। অথচ, এই আর্ট গ্যালারির ঠিক উল্টো দিকেই সবুজ পর্দা টেনে অন্তত ৫০-৬০ ফুট উঁচু বহুতলের কাজ চলছে।

ভূমিকম্প হলে ফাঁকা জায়গায় দৌড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তেমন ফাঁকা জায়গা কি আদৌ দার্জিলিংয়ে আছে? ম্যাল থেকে চকবাজার, কোথাও তেমন বালাই চোখে পড়ল না। দার্জিলিং টয় ট্রেন স্টেশন থেকে যত দূর পর্যন্ত শহর দেখা যায়, গোটাটাই কংক্রিটের জঙ্গল। অথচ, সিকিমের মতো দার্জিলিংও সিসমিক জোন ৪ ও ৫-এর মধ্যে পড়ে। ২০১১-র ১৮ সেপ্টেম্বরের সিকিমের ভূমিকম্পে দার্জিলিংয়েও বেশ কিছু বাড়িতে চিড় ধরেছিল। তার পরও কথা ভূমিকম্পের কথা মাথায় রাখা হচ্ছে না? অধ্যাপক ভাণ্ডারি বলছেন, ‘‘শুধু তো স্থানীয় মানুষ নন, পিক সিজ়নে ভূমিকম্প হলে হাজার-হাজার পর্যটকও বিপদে পড়তে পারেন। মনে রাখতে হবে, ২০১১-র ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল উত্তর সিকিমে। দার্জিলিংয়ে কেন্দ্র হলে কী হবে, ভাবতে পারছেন? ভূমিকম্পের পর বেশি বৃষ্টি হলে ধসের আশঙ্কাও বাড়ে। যেটা আমরা নেপাল ভূমিকম্পের পর মিরিকে দেখেছি।’’

উদ্বেগের শেষ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ছে। পাহাড়ে প্রবণতা আরও বেশি। অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টি হলে কোথাও না কোথাও ধস অনিবার্য। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, গত বর্ষায় অসমের নিউ হাফলং স্টেশন তার সাক্ষী হয়েছে। কাদার স্রোতে গোটা স্টেশন তো বটেই, ডুবে গিয়েছিল ট্রেনও। তার উপর নিকাশির কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থাই নেই দার্জিলিংয়ে। সারা বছরের নিকাশির জল তো বটেই, প্রবল বৃষ্টির জল বইবে কোন জায়গা দিয়ে? জল যদি পাহাড়ি ভূগর্ভে ফিরে যায়? উদ্বেগের কথা শোনাচ্ছেন অধ্যাপক ভাণ্ডারি। তিনি বলছেন, ‘‘পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে জল ঢুকে গেলে বিরাট চাপ তৈরি হয়। এই চাপ যখন পাহাড় আর নিতে পারে না, তখনই ধস নামে।’’
আজ জোশীমঠ, কাল দার্জিলিং? ভুল প্রশ্ন করলাম?

Next Article