Kumartuli: কাঁদছে কুমোরটুলি!
Kumartuli: পুজোর আগের সেই চেনা আমেজেই যেন বাধ পড়েছে এই বারে। একলা ঘরে বসে বাল্বের আলোয় প্রতিমাকে রূপ দিতে ব্যস্ত শিল্পীরা। তবু খরিদ্দারের দেখা নেই।
কোথাও টিনের চাল, কোথাও ত্রিপলের ছাউনি! সরু, তস্য সরু গলি। আর তার মধ্যেই থরে থরে লাইন দিয়ে সাজানো রয়েছে মাতৃ মূর্তি। তাঁর দশ হাত। ছোট বড় নানা মাপের রং বেরঙের মূর্তি। তার সঙ্গে রয়েছে মেঠো গন্ধ আর প্যাচপ্যাচে কাদা।
সাধারণত এই সময়ে এই জল-কাদা মধ্যেও মানুষের ঢল নামে কুমোরটুলির অলিতে গলিতে। এই সময় বলতে পুজোর মাস খানেক আগে থেকেই। কেউ আসেন পুজোর জন্য ঠাকুরের বায়না দিতে। কেউ আসেন আগে থেকে বায়না দেওয়া ঠাকুরের কাজ কতদূর এগোলে তা দেখতে। আবার কেউ আসেন মায়ের গায়ে কোন রঙের শাড়ি উঠবে, কোন গয়না পরানো হবে মাকে তা পরখ করে নিতে। এখন থিম পুজোর রমরমা। তাই পুজোর একমাস আগেই বায়না দেওয়া ঠাকুর মণ্ডপে নিয়ে যেতেও আসেন অনেকে।
কিন্তু পুজোর আগের সেই চেনা আমেজেই যেন বাধ পড়েছে এই বারে। একলা ঘরে বসে বাল্বের আলোয় প্রতিমাকে রূপ দিতে ব্যস্ত শিল্পীরা। তবু খরিদ্দারের দেখা নেই।
তিলোত্তমা কাণ্ড নিয়ে উত্তাল শহর। মিছিলে, মানববন্ধনে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। পায়ে পায়ে প্রতিবাদ সামিল হয়েছে কল্লোলিনি তিলোত্তমা। তাই কি ভাটার টান কুমোরটুলিতে? শিল্পীরা মনে করছেন তাইই।
এই বিষয়ে টিভি৯ বাংলা ডিজিটালকে শিল্পী ইন্দ্রজিৎ পাল বলেন, “আমি আমার সারা জীবনে কোনদিন এইরকম নিস্তব্ধ কুমোরটুলি দেখিনি কখনও। ঠাকুরকে কী কাপড় পরানো হবে? কী গয়না এসেছে তাই দেখতেই ভিড় করতো কাস্টোমাররা। কিন্তু এই বছর সেই সব কিছুই নেই।”
শিল্পী মিন্টু পাল বলেন, “এই বছরের পুজো নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে অনেক দোটানা রয়েছে। অনান্য বার এই সময় কুমোরটুলিতে অনেক মানুষের ভিড় থাকে। এই বার সেই সংখ্যাটা অনেক কম।”
কুমোরটুলির মহিলা প্রতিমা শিল্পী মালা পাল। প্রতিমা তৈরির কাজে যখন পুরুষদের আধিক্য ছিল তখন এই কাজকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়ে নিজেই এক উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। সমাজের বাঁধন ছিঁড়ে নিজের পরিচিতি গড়েছেন নিজের হাতেই। সেই মালা পাল বলেন, “আরজিকর কাণ্ড হওয়ার আগে ভালই অর্ডার আসছিল। তবে এই ঘটনা হওয়ার পরে তার প্রভাব পড়েছে। খদ্দেরদের আনোগোনা কমেছে। তাঁরা কিছুটা ওখানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।”
বছরের এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আয় কলকাতার কুমোর পাড়ার। এই সরু গলি থেকে প্রতিমা তৈরি হয়ে যায় দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। পেটের দায়ে প্রতিমা তৈরি করতে হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তবু কুমোরপাড়ার মুখেও এবারে আর প্রতিমার দাম নিয়ে দর কষাকষি নয়, শোনা যাচ্ছে ‘জাস্টিস ফর তিলোত্তমা’, ‘তিলোত্তমার বিচার চাই’।
শিল্পী গোবিন্দ পাল নিজের ঘরেই মায়ের চোখ আঁকতে ব্যস্ত ছিলেন। টিভি৯ বাংলার প্রতিনিধি এমন সময়ে হাজির হয় তাঁর কাছে। তিনি বলেন, “আমরা সারা বছর এই শিল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই কাটাই। রাজনীতি বুঝি না। রাজনীতি আছে তার জায়গায় শিল্প আছে নিজের জায়গায়।”
প্রতিমা বানানোর অর্ডার আসছে অনলাইনে। কুমোরটুলি থেকে বিমুখ জনতা। ‘উৎসবে ফেরার’ কথা বললেও এখনও উৎসব বিমুখ কলকাতা। প্রতিমা তৈরি তো করছেন। তবু মন ভাল নেই। প্রতিমা বিক্রিও হবে তো? এই চিন্তা মাথায় রয়েছেই।
ক্রেতাদের আনাগোনা নেই। ফাঁকা বাজারের প্রতিমা তৈরি করতে ভাল লাগে না শিল্পীদেরও। তবু কোথাও সবার আগে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তিলোত্তমা কাণ্ড। এই নারকীয় হত্যার প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই পথে নেমেছেন কুমোরটুলির শিল্পীরাও। ‘বিচার চায়’ ওঁরাও।
ইন্দ্রজিৎ পাল বলেন, “মন ভেঙে গিয়েছে। আগে যত আনন্দ নিয়ে আমরা ঠাকুর বানাতাম এখন আর তা নেই। বারবার ওই মেয়েটির কথা মনে পড়ছে। সে একজন ডাক্তার। ভগবানের পরেই তাঁদের স্থান। তাঁরাই যদি সুরক্ষিত না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে?”
মিন্টু পাল বলেন, “আরজিকরের মতো একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, দৈনন্দিন একটা প্রতিবাদ প্রত্যেকটা মানুষই করছে। আমাদের দুর্গা বিচার পাক এই দাবি নিয়ে কুমোরটুলি থেকে পথে নেমেছিলাম আমরাও।”
কাঁদছে ‘তিলোত্তমা’, কাঁদছে শহর, কাঁদছে তিলোত্তমাও। কাঁদছে কুমোরটুলিও। তবু মন ভাঙলেও মুখে একটাই স্বর তিলোত্তমা বিচার পাক, বিচার পাক তিলোত্তমারা!