পশ্চিমবঙ্গ: চুম্বক তো নানারকমের হয়, কিন্তু গোটা দেহ রাতারাতি চুম্বকে পরিণত হয়েছে এমন কি সম্ভব! তাও আবার করোনা টিকা নেওয়ার পর! সাধারণত, করোনা টিকার নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্বর আসা, হাতে পায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা হতে পারে। ওষুধেই তা নিরাময় সম্ভব। কিন্তু, টিকা নেওয়ার পর গোটা দেহ চুম্বক হয়ে গিয়েছে এমন দাবি করছেন খোদ টিকাপ্রাপক। ইতিমধ্যেই ‘ম্যাগনেট ম্যান’ (Magnet Man) বলে চর্চায় এসেছেন ওই তিন টিকাপ্রাপক। শিলিগুড়ির নেপাল চক্রবর্তী গত ৭মে কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ় নেন। তারপর থেকেই তাঁর দেহ চুম্বকে পরিণত হয়েছে বলে দাবি পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রবীণের। গায়ে হাতা খুন্তি, চামচ,চাবি, টাকার কয়েন, যা-ই দেওয়া হচ্ছে তাই আটকে যাচ্ছে। ঠিক যেন চুম্বক! যদিও, এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ শিলিগুড়ির চিকিৎসক মহল। তাঁদের দাবি, ওই ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আপাতত, তাঁর সম্পূর্ণ শারীরিক বিশ্রামের প্রয়োজন।
অন্যদিকে, বসিরহাটের হিঙ্গলগঞ্জের বাসিন্দা ৭৪ বছরের শঙ্কর প্রামাণিক কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ় নেন গত ৮ এপ্রিল। রবিবার, দুপুরে মুদিখানার দোকান থেকে কিছু জিনিস কিনতে গিয়ে টাকা দেওয়ার সময় খুচরো কয়েন দেন। তখন দেখা যায়, কয়েনগুলি তাঁর গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাচ্ছে। শঙ্করবাবু বলেন, “ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে এমন হচ্ছে কি না জানিনা। তবে, আমার শারীরিক কোনও সমস্যা নেই।” যদিও এই ঘটনায় ধন্দে চিকিৎসক মহল।
হিঙ্গলগঞ্জ, শিলিগুড়ির পাশাপাশি আসানসোলেও পাওয়া গেল ‘ম্য়াগনেট ম্যান’-এর খোঁজ। ২৭ বছরের অঙ্কুশ সাউ গত ৮জুন পুরনিগমের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোভ্য়াক্সিন নেন। তারপর থেকেই তাঁর গায়ে লোহার চামচ, গাড়ির চাবি, বা গাড়ির রেঞ্জ যেকোন ধাতব বস্ত চুম্বকের (Magnet) মত আটকে যাচ্ছে। অঙ্কুশের দাবি, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এর আগে কখনও এমন হয়নি।
এর আগে নাসিকের বাসিন্দা অরবিন্দ সোনারের ক্ষেত্র কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার পর এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ভাইরাল হয়েছিল সেই ভিডিয়ো। চিকিৎসকেরা যদিও বারবার বলেছিলেন, ভ্যাকসিন নিলে দেহে চুম্বকীয় প্রভাব পড়ে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। একই কথা বলেছে সিডিসিও। তারপরেও কী করে এই ঘটনা ঘটছে তা দেখে অবাক আমজনতা। প্রশ্ন উঠছে কোভিশিল্ডের প্রভাবে কি এমন হতে পারে?
ড. শ্যামাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই ধরনের খবর পেয়েছি। তবে এখনও পর্যন্ত এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাইনি। কী কারণে এমন হচ্ছে বা আদৌ হওয়া সম্ভব কি না তা বলতে পারব না।” মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড.সুমন পোদ্দার বলেন, “আমাদের দেশে এমনও হয়েছে যে গণেশ বাটি থেকে দুধ খাচ্ছে বলে মানুষ বিশ্বাস করেছে। ফলে, এই ধরনের ঘটনা হওয়া ও প্রচার পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, যদি ভ্যাকসিন (COVID Vaccine) নেওয়ার পরেই দেহ চুম্বকে পরিণত হয়, তাহলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তির দেহে ইলেকট্রো ম্য়াগনেট ফিল্ড তৈরি হয়েছে। এখন, দেহে কোনও চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হল তা কেবল হাতা খুন্তিকে টানবে তা কি বিশ্বাসযোগ্য?বা, যেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তিনি কি কোনও রকমের বৈদ্যুতিক বা ধাতব পদার্থের সংস্পর্শে আসছেন না? সেই ক্ষেত্রে ওই ব্য়ক্তি তো রাস্তা দিয়ে গেলে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে সেঁটে যাওয়ার কথা! তা না হয়ে কেবল গায়ে কয়েন হাতা খুন্তি আটকে যাচ্ছে তা কি অস্বাভাবিক নয়?”
প্রায় একই কথা বলেছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড. কুণাল সরকারও। তিনি স্পষ্টই বলেন, “পৃথিবীতে ৮০ কোটি মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। কারোর কিছু হল না, শুধু চারটি লোকের এমন হল, তা কি সম্ভব! তার চেয়েও বড় কথা বৈজ্ঞানিক ভাবে এই ধরনের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণ একটি ভ্রান্ত ঘটনা। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরিতেই এই ধরনের ঘটনার অবতরণ করা হচ্ছে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্য়াপক পদার্থবিদ ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ধাতব পদার্থ তখনই আকর্ষিত হয়, যদি তা চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কাছাকাছি যায়। মানুষের শরীরে আয়রন থাকে যা থেকে সাময়িক ধারণা হতেই পারে যে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই আয়রন একটি যৌগরূপে থাকে। তার গঠন সম্পূর্ণ আলাদা। পৃথক চৌম্বকীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করার মতো ক্ষমতা সেই আয়রনের নেই। অন্যদিকে, যদি ঘর্ষণজনিত কারণে স্থির তড়িৎ উৎপন্নের জেরে সাময়িক ভাবেও দেহে তা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে এই ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।” উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রধান অধিকর্তা চিকিৎসক সন্দীপ সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, এই ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। আক্রান্ত নেপালবাবুকে হাসপাতালে দুদিন পর্যবেক্ষণে রাখার কথাও বলেছেন ড. সেনগুপ্ত।
আরও পড়ুন: ‘মান-বিতর্ক’! উপাচার্যের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগের পাল্টা শোকজ নোটিস অধ্যাপককে, চর্চায় বিশ্বভারতী