বাঁকুড়া: ভাতায় মেটে না অভাব, সংসার টানতে বাধ্য হয়ে মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শিশু শ্রমিক হিসাবে কাজে পাড়ি দিচ্ছে অনেকে, উচ্চ শিক্ষিত হয়েও চাকরি না মেলায় অভিভাবকদের মধ্যেও বাড়ছে হতাশা। অষ্টম শ্রেণির পর মিড ডে মিল না থাকাতেও কমছে লেখাপড়ায় আগ্রহ। জেলায় জেলায় ছবিটা ঠিক এমনটাই।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পান, পান রেশনের বিনা পয়সার চালও। কিন্তু তাতে কী আর মেটে সংসারের অভাব? একশো দিনের কাজ বন্ধ। সেচের অভাবে কৃষি শ্রমিক হিসাবে কাজও সেভাবে মেলে না। নিজস্ব জমি না থাকায় পরিবারের সারা বছরের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটানোই রীতিমতো দায়। তবু একরাশ স্বপ্ন নিয়ে পরিবারের নতুন প্রজন্মকে স্কুলে পাঠান। কিন্তু একদিকে সরকারি স্কুলের বেহাল পরিকাঠামোতে অল্পদিনেই তাঁদের গ্রাস করে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। অগত্যা বড়জোর ক্লাস এইট। তারপরেই লেখাপড়ায় ইতি টেনে কেউ মহারাষ্ট্রে কেউ আবার গুজরাটে পাড়ি দেওয়াই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের পুনিশোল গ্রামে। কমবেশি সব পরিবারেই পরিস্থিতিটা এমনই।
পুনিশোল গ্রামের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা নাজিরুদ্দিন খান। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে একচিলতে খড়ের বাড়িতে বসবাস। পরিবারের রোজগার বলতে বাড়ির অদূরে ছোট্ট পানের দোকান। সেভাবে দোকান না চলায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় নাজিরুদ্দিনকে। পরিবারের বড় সন্তান আনজার আলি খানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন নাজিরুদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী নাজিবুন। ইচ্ছা ছিল ছেলে একদিন লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ালে সংসারে কিছুটা সাহায্য হবে। অন্য ছেলেমেয়েগুলির লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা সাহায্য হবে। কিন্তু, আনজার যত বড় হতে থাকে ততই নাজিরুদ্দিন ও নাজিবুন বুঝতে পারেন স্বপ্ন আর বাস্তবের দূরত্ব অনেক! ক্লাস এইটের পর লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণি পেরোতেই লেখাপড়া ছেড়ে আনজার পাড়ি দেয় মুম্বা। সোনার কারখানায় শিশু শ্রমিক হিসাবে সেখানেই কাজে যোগ দেয় সে। আপাতত ছেলের স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রনা নিয়ে চোখের জলে দিন কাটাচ্ছেন নাজিরুদ্দিন ও নাজিবুন।
তবে শুধু নাজিরুদ্দিন বা নাজিবুনই নয়, একই ধরনের স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা গ্রাস করছে গ্রামের বহু অভিভাবককেই। একদিকে সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোর বেহাল অবস্থা অন্যদিকে পরিবারের চূড়ান্ত দারিদ্রের জেরে ধীরে ধীরে গোটা গ্রামের নতুন প্রজন্ম পরিণত হচ্ছে পরিযায়ী শিশু শ্রমিকে।