পশ্চিমবঙ্গ: ঊর্ধ্বমুখী করোনাগ্রাফ রুখতে রাজ্যজুড়ে জারি হয়েছে লকডাউন। জোর দেওয়া হয়েছে টিকাকরণে। বাড়ানো হয়েছে টিকার জোগান। করোনা মোকাবিলায় রাজ্যজুড়েই চলছে বিনামূল্যে করোনাটিকা প্রদান। আর এই টিকাকরণকে (COVID Vaccination) কেন্দ্র করেই রাজ্য জুড়ে কোথাও বিক্ষোভ, কোথাও বা স্পষ্ট হচ্ছে দুর্নীতির ছবি।
জলপাইগুড়ি:
জলপাইগুড়ি জেলায় মঙ্গলবার থেকে ফের শুরু হল ৪৫ ঊর্ধ্বদের করোনা টিকা প্রদানের কাজ। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার মোট ১১টি সেন্টার থেকে টিকা প্রদান করা হবে। সাংবাদিক থেকে হকার, গণপরিবহনকর্মীদের টিকাকরণ করা হবে বলে জানা গিয়েছে। জলপাইগুড়ি ফার্মেসি কলেজ সেন্টার থেকে মোট ৪০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে জানা গিয়েছে। ভ্যাকসিন পেতে মাঝরাত থেকেই দীর্ঘ লাইন পড়তে দেখা যায় টিকাকরণ কেন্দ্রের সামনে।
অন্যদিকে, চিকিৎসক দের যোগসাজশে মোটা টাকার বিনিময়ে ভ্যাক্সিন বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ করলেন রাজগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক খগেশ্বর রায়। জলপাইগুড়ি রাজগঞ্জ বিধানসভার বেলাকোবা গ্রামীণ হাসপাতালে ভ্যাকসিন কান্ডে গ্রামবাসীদের অভিযোগে সিলমোহর দিয়ে ঐ হাসপাতালের চিকিৎসক কিংশুক ভৌমিককে কাঠগড়ায় তুললেন বিধায়ক।খগেশ্বর জানান চিকিৎসক কিংশুক ভৌমিকের নেতৃত্বে হাসপাতালের বেশ কিছু চিকিৎসক বাইরে থেকে লোক এনে মোটা টাকার বিনিময়ে ভ্যাকসিন দিচ্ছেন। ফলে, টিকা (COVID Vaccine) পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। উত্তরবঙ্গ জনস্বাস্থ্য় আধিকারিকের তরফ থেকে এই ঘটনাপর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে এমনটাই জানিয়েছেন রাজগঞ্জের বিধায়ক।
এদিন, টিকাকরণ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বেলাকোবা গ্রামীণ হাসপাতাল চত্বর। টিকাপ্রাপকদের অভিযোগ, নিয়ম না মেনে টিকাপ্রদান করা হচ্ছে। এমনকী, গোপনে ভ্যাকসিন পাচার করাও হচ্ছে। ফল ভুগছেন সাধারণ মানুষ। মঙ্গলবার, প্রায় শতাধিক মানুষ টিকা নিতে হাসপাতাল চত্বরে আসেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, প্রথম ১০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। বাকিদের ফিরে যেতে বলা হয়। সেইসময়ে এক ব্যক্তি বেলাইনে তাঁর আধার কার্ড জমা দেন। যার জেরে শুরু হয় বিক্ষোভ। অভিযোগ, চিকিৎসকের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। জানা গিয়েছে, মিঠুন সরকার নামে ওই ব্যক্তির ভাইয়ের ডায়ালিসিস চলছে। তাই, অসুস্থ ভাইকে গাড়িতে বসিয়েই টিকা নেওয়ার জন্য লাইনে না দাঁড়িয়ে আধার কার্ড জমা দেন। আর তাতেই, বিক্ষোভ শুরু হয় হাসপাতাল চত্বরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে আসে জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার পুলিশ।
আলিপুরদুয়ার:
মঙ্গলবার সকাল থেকে করোনা টিকা পেতে ভিড় উপচে পড়েছে আলিপুরদুয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।প্রায় মাঝরাত থেকে টিকা পেতে লাইন দিয়েছেন অনেকে। লকডাউনের ফলে বন্ধ পরিবহন। ফলে পায়ে হেঁটেই টিকা নিতে এসেছেন অনেকে। তবে সবাই টিকা পাবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেক টিকাপ্রাপকই। প্রায় তিনশো থেকে চারশো জন মানুষ এদিন টিকা নিতে স্বাস্থ্য়কেন্দ্রে আসেন। কোভিড বিধি উপেক্ষা করে টিকা নেওয়ার এই ধূম ক্ষতিকারক হতে পারে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। সেক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য়কেন্দ্রগুলি টিকাপ্রাপকদের সংখ্যা বেঁধে দিক, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দক্ষিণ দিনাজপুর:
করোনার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময়ে বদলি হতেই ফাঁকা বালুরঘাটের করোনা ভ্যাকসিন সেন্টার। করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজটি কবে নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে সোমবার নতুন নির্দেশিকা জারি করে স্বাস্থ্য দফতর। ফলে, বদলির সময় জানতে না পেরেই টিকাকরণ কেন্দ্রে এসেছিলেন অনেকেই। কিন্তু, সময়ের বদলি হওয়ায় টিকা না পেয়েই ফিরে যান সকলে। একদিকে করোনা মোকাবেলায় গত রবিবার থেকে শুরু হয়েছে লকডাউন। এই অবস্থায় দূর দূরান্ত থেকে ভ্যাকসিন নিতে এসে ঘুরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে নতুন নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের সময়সীমা ৪২ থেকে বেড়ে ৮৪ দিন করা হয়েছে। এদিকে কোভিশিল্ডের (COVISHIELD) ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডোজের সময়সীমা ৪২ থেকে বেড়ে করা হয়েছে ৮৪ এবং কোভ্যাকসিনের (COVAXIN) ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সময়সীমা ২৮দিন থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৫ দিন। এদিকে লকডাউনের মধ্যে ভ্যাকসিন নিতে এসে হয়রানির মুখে পড়ছেন টিকা প্রাপকরা। হঠাৎ করে সময় বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সমস্যা হচ্ছে এমনটাই অভিযোগ টিকাপ্রাপকদের। এদিকে, করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার প্রক্রিয়াও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় করোনা টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার জনকে এবং দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৮০ হাজার। এছাড়াও বর্তমানে সেকেন্ড ডোজের জন্য রয়েছে ১২ হাজার ৭০০ এবং প্রথম ডোজের জন্য ১০ হাজার ভ্যাকসিন রয়েছে। পাশাপাশি, মঙ্গলবার নতুন করে আরও ১৬ হাজার ৫০০ ভ্যাকসিন জেলায় আসছে বলে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ সুকুমার দে জানিয়েছেন।
পুরুলিয়া:
করোনা টিকাকরণকে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা গেল রঘুনাথপুরে। মঙ্গলবার, রঘুনাথপুরের ১ নম্বর ব্লক উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে টিকা পেতে লাইন দেন সাধারণ মানুষ। করোনায় সামাজিক দূরত্ব বিধিকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়েই এদিন উপস্বাস্থ্য়কেন্দ্রে দেখা যায় টিকাপ্রাপকদের দীর্ঘ লাইন। আচমকা লাইনে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে দুই টিকাপ্রাপকের মধ্যে শুরু হয় বচসা। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে হতে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। পরে, রঘুনাথপুর থানার পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বি এম ও এইচ কিংশুক কর্মকার জানান লাইনে দাঁড়ানো দের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে, নিজেরা সচেতন না হলে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যাবে না।
উত্তর ২৪ পরগনা:
পর্যাপ্ত টিকার জোগান না থাকায় প্রায় পাঁচদিন ধরে হাড়োয়া গ্রামীণ হাসপাতালে বন্ধ থাকল টিকাকরণ। মঙ্গলবার থেকে দ্বিতীয় ডোজ বন্ধ হলেও প্রথম ডোজ অনেক আগে থেকেই বন্ধ ছিল। টিকাপ্রাপকদের অভিযোগ, হাড়োয়া জুড়ে ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার বেড়েই চলেছে। দিনের পর দিন ভোর চারটে থেকে আবার কেউ ভোর পাঁচটা থেকে ইটের উপরে নাম লিখে টিকা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভ্যাকসিন না পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে বাড়িতে ফিরছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। হাড়োয়া পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্যের কর্মাধ্যক্ষ সুশান্ত বিশ্বাস বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি করছে। সাধারণ মানুষের প্রাণের মূল্য তাদের কাছে নেই। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তাদের বাধে না।”
উল্লেখ্য, কোউইন অ্যাপের বিগত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যান বলছে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩.৩ শতাংশ মানুষ এখনও পর্যন্ত করোনার টিকা পেয়েছেন। শুধমাত্র ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়া গেছে ৮.৮ শতাংশ রাজ্যবাসীকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, যে সমস্ত রাজ্যবাসীকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া গেছে তাঁদের যদি টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যায় তাহলে রাজ্যে কোভিড সংক্রমণের হার কিছুটা কমতে পারে। কোউইন অ্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে মোট ১ কোটি ২১ লাখ ৯ হাজার ৯৯২ জনের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। রাজ্যবাসীকে কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিন ২ ধরণের টিকাই প্রয়োগ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: লকডাউনকে ‘থোড়াই কেয়ার’! ‘হিরোগিরি বন্ধ করুন’, কোথাও ধমক দিলেন বিধায়ক, কোথাও চলল পুলিশি অভিযান