বীরভূম: দিনটা ছিল সোমবার। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। ২১ মার্চ। ২০২২ সাল। এক নারকীয় হত্যালীলার (Bagtui Massacre) সাক্ষী থেকেছিল গোটা বাংলা। একটা গোটা গ্রাম যেন রাতারাতি শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। সে এক অভিশপ্ত রাত। একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শোনা যায়, মোট ১২টি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছিল। জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল আটজনকে। পুরুষ-মহিলা-শিশু কাউকে রেয়াত করা হয়নি। পরে হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আরও দুই জনের মৃত্যু হয়েছিল। সব মিলিয়ে ১০টা তরতাজা প্রাণ গিলে খেয়েছে সেই নারকীয় রাত। যাঁরা সেই রাতে প্রাণে বেঁচেছিল, সেই মিহিলালদের কাছে ওই রাতটা এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো।
বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখের খুনের ঘটনা থেকেই শুরু হয়েছিল সবকিছু। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে তিনি আড্ডা মারছিলেন। সেই সময়েই দুটি বাইকে চেপে আসে চার দুষ্কৃতী। বোমাবাজি করতে থাকে সেখানে এবং দুষ্কৃতীদের মধ্যে থেকে একজন গুলি করে। ভাদু শেখের খুনের পর বদলা নিতে বগটুই গ্রামে চড়াও হয়েছিল একদল দুষ্কৃতী। বেছে বেছে বগটুইয়ে ভাদু বিরোধী বলে পরিচিত ১২টি বাড়িতে পর পর আগুন লাগিয়ে দেয়। চলে উন্মত্ত এক তাণ্ডবলীলা।
পুড়ে খাক হয়ে যায় দশটি তরতাজা প্রাণ। গ্রাম থেকে উদ্ধার হয় আটটি আধপোড়া দেহ। পরে হাসপাতালে আরও দুইজনের মৃত্যু। বাদ যায়নি নয় বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা কেউই। শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসা সদ্য বিবাহিত মেয়ে জামাইও সেদিন হিংসার আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। গোটা গ্রামে স্বজন হারানোর আর্তনাদ। হাহাকার। আর আধ পোড়া মাংসের গন্ধ। মানুষ-পোড়া মাংসের গন্ধ। বীভৎস সেই হত্যালীলার এক বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু সেই দুঃস্বপ্নের রাত যেন আজও তাড়া করে বেড়ায় মিহিলালদের।
ঘটনাটি ঘটেছিল ২১ মার্চের রাতে। হত্যালীলার তিন দিন পর, ২৪ মার্চ বগটুই গ্রামে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন নৃশংস ঘটনার পরেও কেন তিন দিন দেরি হল মুখ্যমন্ত্রীর বগটুই যেতে, তা নিয়ে অনেক খোঁচা দিয়েছিলেন বিরোধীরা।
কেন ঘটনার পর পুলিশ সময়মতো সেখানে যায়নি, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বগটুইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়েই ডিজিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আনারুলকে গ্রেফতার করতে হবে। যেখান থেকে হোক, আনারুলকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরাসরি কাঠগড়ায় তুলেছিলেন এসডিপিও, আইসির ভূমিকাকে। বলেছিলেন, যাঁরা দায়িত্ব পালন করেননি,তাঁদের কঠোর শাস্তি চাই। সঙ্গে এও বলেছিলেন, এমনভাবে কেস সাজাতে হবে, যাতে অভিযুক্তরা ছাড় না পায়।
মুখ্যমন্ত্রী যখন বগটুইয়ে গিয়েছেন, তখন তিনদিন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু গোটা বগটুইজুড়ে তখনও এক শ্মশানের স্তব্ধতা। সবাই ভয়ে, আতঙ্কে সিঁটিয়ে। সেই বগটুইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে মৃতদের প্রত্যেককে পরিবারপিছু ৫ লাখ টাকা করে আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যাঁরা ৬০ শতাংশ দগ্ধ, তাঁদের ১ লাখ টাকা করে আর্থিক সাহায্য এবং অগ্নিদগ্ধ তিন শিশুর জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, আগুনে যাঁদের বাড়ি পুড়ে গিয়েছে, তাঁদের বাড়ি তৈরির জন্য ১ লাখ টাকা (প্রয়োজনে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত) দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছিলেন, প্রত্যেকের চিকিৎসার দায়িত্ব রাজ্যের। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির থেকে একজনকে সরকারি চাকরির কথাও বলেছিলেন তিনি।
নৃশংস সেই হত্যালীলার এক বছর পার। আধ পোড়া মাংসের বোটকা গন্ধ যেন আজও ঘুরে বেরায় বগটুইয়ে। কোনও এক দমকা হাওয়ায় যেন বার বার ফিরে আসে সেই মানুষের মাংস পোড়া গন্ধ। কিন্তু এরই মধ্যে চলছে রাজনৈতিক তর্জা। এখন মিহিলালের বাড়ির সামনে একটা শহিদ বেদি তৈরি করেছে বিজেপি। সেই দুঃস্বপ্নের রাতে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে। পাল্টা একটি বেদি আবার শাসক শিবিরও তৈরি করছে। আর এসব নিয়েই চলছে রাজনীতির পারদ। কিন্তু বগটুইয়ের স্বজনহারা মানুষগুলোর কথা কতজন মনে রেখেছে? ওরা কি এখন রাতে ঘুমোতে পারে? ঘুমের ঘোরে কেঁপে উঠে না তো? মাঝরাতে সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেরায় না তো ওদের? ঘুম ভেঙে যায় না তো মাঝরাতে? সেই খোঁজ কি কেউ রেখেছে?