শ্রীরামপুর: একসময়ে একটি বাসে চেপেই হুগলির শ্রীরামপুর থেকে সরাসরি চলে যাওয়া যেত উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। সেই বাসটি ছিল ৩ নম্বর রুটের বাস। বলা যায়, হুগলির শহরতলীর লোকেদের বড় ভরসার জায়গা ছিল এই বাস। স্কুল, কলেজ, অফিস, হাসপাতাল যেতে এই বাসই ছিল অন্যতম প্রধান সারথি। ১০-১৫ বছর আগেও বাসটি দেখা যেত। তখন এই রুটে ৭০টি ৩ নম্বর বাস চলত। কিন্তু, ক্রমশ অটো, টোটোর দাপটে গত কয়েক বছরে জেলার এই বাসের ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। লাভ না হওয়ায় বাস তুলে নেন মালিকেরা। বর্তমানে ৩ নম্বর রুটের বাস এখন ইতিহাসের পথে। সবেধন নীলমণি হয়ে টিকে রয়েছে ৩ নম্বর রুটের একটিমাত্র বাস। যার মালিক সুদীপ গোস্বামী নিজেই কন্ডাক্টরি করেন।
হুগলির বাসিন্দা সুদীপবাবু জানান,৩৮ বছর ধরে ৩ নম্বর বাস পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তিনি। তাঁর চোখের সামনেই ধীরে-ধীরে হারিয়ে গিয়েছে এই রুটটি। আক্ষেপের সুরে সুদীপবাবু বলেন, “চোখের সামনে দেখলাম কত বাস বন্ধ হয়ে গেল। আমার এই বাসটি ২০১১ সালের। এখনও চালাচ্ছি কোনভাবে। প্রতিদিন হয়ত খরচও ওঠে না। মায়া পড়ে গিয়েছে বাস আর এই ৩ নম্বর রুটের প্রতি। তাই চালাই। যদিও এখন আর বাগবাজার পর্যন্ত চলে না এই বাস।” সুদীপবাবু বলেন, “যাত্রী মেলে না। তাই এখন আর বাগবাজার নয় দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত বাস চালাই। সারা দিনে চারবার চলে। মাস গেলে দেখা যায়, আয়-ব্যয় সমান অথবা ঘরের টাকা দিয়ে হিসাব মেলাতে হয়।”
শুধু ৩ নম্বর বাস নয়, শ্রীরামপুর থেকে শহরতলীর অনেক বাসই বর্তমানে ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। যেমন, শ্রীরামপুর থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত চলত ১২ নম্বর বাস, শ্রীরামপুর-জাঙ্গীপাড়া ৩১ নম্বর বাস, শ্রীরামপুর-ভগবতীপুর ২২৫ নম্বর বাস, শ্রীরামপুর-নবাবপুর-ডানকুনি ২২৫/এ রুটের বাস, শ্রীরামপুর-ডোমজুর ২১৪ মিনি, শ্রীরামপুর-চুঁচুড়া ২ নম্বর বাস চলত। এখন সবই প্রায় বন্ধের মুখে। আগে শ্রীরামপুর থেকে প্রায় ১৫টি বাস চলত। বর্তমানে ৪০টির মতো চলে। তার মধ্যে ৩ নম্বর রুটের একটি মাত্র বাস বেঁচে আছে।
অটো-টোটোর দৌরাত্ম্যেই এই সমস্ত বাস বন্ধের মুখে এবং বাসের মতো গণ পরিবহণ ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। বাস মালিকদের অভিযোগ, ছোট দূরত্বে যেতে এখন আর কেউ বাসে চাপতে পছন্দ করেন না। তাই মার খাচ্ছে বাস-ব্যবসা। এর সঙ্গে আছে অবৈধ অটো চলাচল। এসব নিয়ে পরিবহণ দফতর থেকে জেলা প্রশাসনে একাধিকবার জানালেও কোনও সুরাহা হয়নি বলে দাবি বাস মালিকদের।
এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সরকার প্রত্যেক বাসে ভেহিকেল লোকেশান ট্রেকিং ডিভাইস বা ভিএলটিডি বাধ্যতামূলক করেছে। যার খরচ ১২ হাজার টাকা। ভেহিকেল লোকেশান ট্রাকিং ডিভাইসের মাধ্যমে বাসের মধ্যে কোনও বিপদ ঘটলে যাত্রী বাসে থাকা প্যানিক বটন টিপে দিলে স্থানীয় পুলিশ জানতে পারবে। একটি অ্যাপের মাধ্যমে পুলিশ সেই বাস খুঁজে নিয়ে সাহায্য করবে। জিপিআরএস-এর মাধ্যমে এই অ্যাপ চলবে। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে সব বাসে ভিএলটিডি লাগাতে হবে। ফলে সমস্যায় পড়েছেন বাস মালিকরা।
শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন বাস মালিক সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জন প্রামানিক বলেন, “১৯২৭ সালের বাস রুট ৩ নম্বর। সেই রুটে একটি মাত্র বাস চলছে। আর সেই বাসের মালিক নিজেই কন্ড্রাক্টরি করছেন। এতেই বোঝা যায়, কতটা অসহায় অবস্থা বাস মালিকদের।” তাঁর অভিযোগ, “বাস শিল্পকে বাঁচানোর কোনও উদ্যোগ নেই। অথচ নতুন অ্যাপ লাগাতে বলা হচ্ছে বাসে। তার জন্য সময় বে়ঁধে দেওয়া হয়েছে। বাস মালিকদের ক্ষমতা নেই ১২ হাজার টাকা খরচ করে ভিএলটিডি লাগানোর। আমরা এর জন্য আরও কিছুটা সময় চাই।” যদিও প্রশাসনের তরফে বাস মালিকদের অতিরিক্ত সময় দেওয়ার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।