মালদহ: দু’জন মানুষকে মাথার চুল কেটে, চুন-কালি মাখিয়ে, উল্লাস করে ঘোরানো হল গ্রামের রাস্তায়। সবাই দেখছে। কেউ কেউ ছবিও তুলছে। মালদহের কালিয়াচকের ছবি মধ্যযুগের বর্বরতাকেও যেন হার মানাচ্ছে। অভিযোগ, টানা দু’দিন ধরে অকথ্য চলে নির্যাতন। শারীরিক ও মানসিকভাবে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে ওই দম্পতি। পরকীয়ার অভিযোগ ওঠায় তিনবার বসে সালিসিসভা! এমনই অভিযোগ জানাচ্ছেন ওই দম্পতি। আর সেখানে বিচারের পর তাঁদের সঙ্গে যা হয়, তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। গত শুক্রবারের ঘটনা।
মাথা মুড়িয়ে, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে, মুখে চুন-কালি মাখিয়ে, বাজনা বাজিয়ে, বাজি পুড়িয়ে, উল্লাস করে দম্পতিকে ঘোরানো হল গ্রামে। অভিযোগ, গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য ও এলাকার নেতাদের উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে, সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্য, দুই স্থানীয় কংগ্রেস কর্মী সহ আটজনের বিরুদ্ধে। মোট ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ এখনও পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে।
এমন ঘটনার পর কার্যত কথা বলার অবস্থায় নেই স্বামী বা স্ত্রী কেউই। তবুও কোনওক্রমে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় TV9 বাংলাকে জানালেন তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। তাঁদের দাবি, অত্যাচারের ছবি মোবাইলে রেকর্ডও করেন ‘মাতব্বররা’, পরে সেগুলি পোস্ট করা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অভিযোগ, স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তিন সিপিএম সদস্যের উপস্থিতিতেই বসেছিল তিনবার সালিশিসভা। পরকীয়ার অভিযোগ তুলেই এই অত্যাচার করা হয় দম্পতিকে। তাঁরা জানিয়েছেন, সালিশিসভা শেষে গোটা রাত ওই তাঁদের ঘরবন্দি করে রাখা হয়। জল খেতে চাইলে মুখের কাছে জল ফেলে দেওয়া হয়, খেতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও চিকিৎসার ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়নি! সিগারেটের ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ।
শনিবার এই ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় কালিয়াচক থানার পুলিশ। উদ্ধার করা হয় আক্রান্ত দম্পতিকে। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তাঁদের ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এরপরই কালিয়াচক থানায় ১৯ জনের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। শনিবারই ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সরকারি আইনজীবী দেবজ্যোতি পাল ঘটনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, দুজনের আগের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। কাজী নামা করে এক বছর আগে এই দুজনের বিয়ে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি রাঁচিতে হকারের কাজ করেন, মাঝে মাঝে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। গত শুক্রবার ওই মহিলার প্রাক্তন স্বামী সহ গ্রামবাসীরা দম্পতিকে নিয়ে সালিশিসভা করে। সেখানে এই দ্বিতীয় বিয়েকে মান্যতা দেওয়া হয়নি। এরপর তাঁদের ওপর এই অত্যাচার চলে।
স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য সেতাউর রহমানের দাবি, তৃণমূল তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তিনি জানিয়েছেন, আগে তিনি তৃণমূলের সদস্য ছিলেন। গত পঞ্চায়েতে জোট প্রার্থী হয়ে ভোটে জিতেছেন। সেই কারণেই তাঁকে এভাবে ফাঁসানো হচ্ বলে অভিযোগ। তাঁর দাবি, ঘটনার দিন তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না।
অন্যদিকে, জেলা তৃণমূলের সভাপতি আব্দুর রহিম বক্সি বলেন, “কালিয়াচকের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে বুথে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে সিপিএম জিতেছে। তাদের নেতৃত্বেই সালিশিসভা করে এই ধরনের কাজ করা হয়েছে। আমাদের দলের কোনও লোক এই কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়।” আর স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, তৃণমূলের আমলে সারা রাজ্যে নিরাপত্তার অভাব তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সালিশিসভা,গণধোলাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে।