শুভেন্দু দেবনাথ: রিক্সাটা চুরি না গেলে এই পুজোয় কিছু রোজগার হত। নাতি নাতনিদের অন্তত জামা কাপড়টা কিনে দিতে পারতেন। বিড়ি ধরিয়ে এমনই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন ষাটোর্ধ্ব বিজলি সিং। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জীবনতলা গ্রামের বাসিন্দা বিজলি সিং সব হারিয়ে আজ ঠাঁই পেয়েছেন লেকটাউন ফুটব্রিজের ঠিক নীচে। ব্রিজের সিলিংটাই ঘরের ছাদ, আর দেওয়াল বলতে এদিক ওদিক থেকে কুড়িয়ে আনা নানা আকারের ব্যানার-পিচবোর্ড। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী জ্যোৎস্না বিবি ‘মাল'(খালি প্ল্যাস্টিকের বোতল) কুড়োন। তাঁর মেয়ে পরভিন বিবি লোকের বাড়িতে কাজ করেন। দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে। এখন দুই সন্তানের জননী পরভিন। অনেক দিন হল তাঁকে ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন তাঁর স্বামী। আকাশচুম্বী ‘বুর্জ খলিফার’ ‘পাদদেশে’ এমন পাঁচ চরিত্রের জোড়াতালি দেওয়া সংসার চাপা পড়ে রয়েছে লেকটাউন উড়ালপুলের নীচে।
ঢিল ছোড়া দূরত্বে এবারের পুজোর সেরা আকর্ষণ শ্রীভূমির ‘বুর্জ খলিফা’। দূরত্ব বড়জোর ৫০০ মিটার। চারদিকে হাজার হাজার ওয়াটের আলোর ঝলকানির ছিটে মাঝেমধ্যে এসে পড়ে তাদের ফুটপাথ-আঙিনায়। রাত বাড়লেই ‘বুর্জ খলিফার’ টানে সেই আঙিনা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নানা রঙের পোশাকের ভিড়ে নিজেদেরই আঙিনায় হারিয়ে যায় পরভিনের দুই সন্তান সুরজমল ও সাদ্দাম। এক জনের বয়স ছয়। আর এক জন চার। পথ চলতি মানুষের ধাক্কায় মজা লুটছে তারা। ‘বুর্জ খলিফা’ দেখতে এতই উন্মত্ত মানুষজন! কেউ কেউ চটুল মন্তব্যও করছেন, ‘সামলানোর ক্ষমতা নেই, গোটা চারেক বাচ্চা প্যায়দা করে রেখেছে।’ তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই আদুর গায়ে কলকাতার দুই ‘যিশুর’।
– পুজোয় জামা প্যান্ট হয়েছে?
ঘাড় নেড়ে নির্বাক সাদ্দামের উত্তর, ‘না’। পাশেই মা পরভিন দাঁড়িয়ে। ছেলেমেয়েদের ঠাকুর দেখতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে, পরভিন বলেন, ‘ঠাকুর দেখতে পয়সা লাগে। ওদের মুখে খাবার তুলে দিতেই অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আবার নতুন জামাকাপর -ঠাকুর দেখা! ওসব আমাদের জন্য নয়।’ পরভিন অত্যন্তই লাজুক। ক্যামেরার সামনে অস্বচ্ছন্দ বোধ করায় একগাল হেসে ফেলেন তিনি। ওই হাসির মধ্যে কত ব্যাথ্যা লুকিয়ে আছে, শুধু পরভিনই জানেন। তাঁর কথায়, বুকে নাকি পোকা হয়েছে (ব্লাড ক্যান্সার)। পোকায় খেয়ে নিয়েছে আধখানা বুক। জানেন না কতদিন বাঁচবেন। স্বামী চলে গিয়েছে অন্য কারোর সঙ্গে। চিকিৎসায় প্রচুর খরচ। পরভিন জানান, পুজোর বোনাসটুকুও জোটেনি। যাঁদের বাড়িতে কাজ করেন, তাঁরা পুজোয় ঘুরতে গিয়েছেন। বিজলি সিং থেকে পরভিন সকলেরই ভরসা জ্যোৎস্না বিবির ‘মাল’ কুড়োনোর রোজগার।
অদ্ভুত পরভিনের ছেলেবেলাও। মাত্র ১০ বছর বয়সে লোকের বাড়িতে কাজ করে ফেরার সময় ভুলবশত অনাথ ভেবে তাকে ধরে নিয়ে যায় হোমের লোকেরা। সেখানেই পরভিনের পরিচয় হয় তারই বয়সী আরেকটি অনাথ মেয়ের সঙ্গে। সেই মেয়েটির সঙ্গেই একদিন পালিয়ে যান হোম থেকে। বন্ধুটিকে নিজের বাড়িতেই আশ্রয় দেন। নিজের নামে তারও নাম দেন ‘পরভিন’। জ্যোৎস্না বিবি তাকে দেন মা ডাকার অধিকার, বিয়ে দেন ছেলের সঙ্গে। দুই পরভিন এখন থাকেন মিলেমিশে। প্রথম পরভিন বিশ্বাস করেন, তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানদের দায়িত্ব নেবেন দ্বিতীয় পরভিন। কারণ, বন্ধুটিকে নিজের নাম, ঘর, সংসার সব দিয়েছেন। কথা বলতে বলতে ‘বুর্জ খলিফার’ লেজার আলোর ছিটে ফের বাস্তবে ফিরিয়ে দেয় পরভিনকে। সন্ধে নেমেছে। এক চিলতের ঘরে নিভু নিভু আলোয় মিশে যায় পরভিন। আঙিনায় ভিড়ের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে তখনও ব্যস্ত সাদ্দাম আর সুরজমল।
আরও পড়ুন: আঁধারে পুজো: বন্যায় ভেসে কলকাতায় ভিরেছে ওরা, ‘মাকে’ কাঁধে না তুলতেই ১০ হাজার টাকা চাঁদা!
শুভেন্দু দেবনাথ: রিক্সাটা চুরি না গেলে এই পুজোয় কিছু রোজগার হত। নাতি নাতনিদের অন্তত জামা কাপড়টা কিনে দিতে পারতেন। বিড়ি ধরিয়ে এমনই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন ষাটোর্ধ্ব বিজলি সিং। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জীবনতলা গ্রামের বাসিন্দা বিজলি সিং সব হারিয়ে আজ ঠাঁই পেয়েছেন লেকটাউন ফুটব্রিজের ঠিক নীচে। ব্রিজের সিলিংটাই ঘরের ছাদ, আর দেওয়াল বলতে এদিক ওদিক থেকে কুড়িয়ে আনা নানা আকারের ব্যানার-পিচবোর্ড। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী জ্যোৎস্না বিবি ‘মাল'(খালি প্ল্যাস্টিকের বোতল) কুড়োন। তাঁর মেয়ে পরভিন বিবি লোকের বাড়িতে কাজ করেন। দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে। এখন দুই সন্তানের জননী পরভিন। অনেক দিন হল তাঁকে ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন তাঁর স্বামী। আকাশচুম্বী ‘বুর্জ খলিফার’ ‘পাদদেশে’ এমন পাঁচ চরিত্রের জোড়াতালি দেওয়া সংসার চাপা পড়ে রয়েছে লেকটাউন উড়ালপুলের নীচে।
ঢিল ছোড়া দূরত্বে এবারের পুজোর সেরা আকর্ষণ শ্রীভূমির ‘বুর্জ খলিফা’। দূরত্ব বড়জোর ৫০০ মিটার। চারদিকে হাজার হাজার ওয়াটের আলোর ঝলকানির ছিটে মাঝেমধ্যে এসে পড়ে তাদের ফুটপাথ-আঙিনায়। রাত বাড়লেই ‘বুর্জ খলিফার’ টানে সেই আঙিনা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নানা রঙের পোশাকের ভিড়ে নিজেদেরই আঙিনায় হারিয়ে যায় পরভিনের দুই সন্তান সুরজমল ও সাদ্দাম। এক জনের বয়স ছয়। আর এক জন চার। পথ চলতি মানুষের ধাক্কায় মজা লুটছে তারা। ‘বুর্জ খলিফা’ দেখতে এতই উন্মত্ত মানুষজন! কেউ কেউ চটুল মন্তব্যও করছেন, ‘সামলানোর ক্ষমতা নেই, গোটা চারেক বাচ্চা প্যায়দা করে রেখেছে।’ তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই আদুর গায়ে কলকাতার দুই ‘যিশুর’।
– পুজোয় জামা প্যান্ট হয়েছে?
ঘাড় নেড়ে নির্বাক সাদ্দামের উত্তর, ‘না’। পাশেই মা পরভিন দাঁড়িয়ে। ছেলেমেয়েদের ঠাকুর দেখতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে, পরভিন বলেন, ‘ঠাকুর দেখতে পয়সা লাগে। ওদের মুখে খাবার তুলে দিতেই অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আবার নতুন জামাকাপর -ঠাকুর দেখা! ওসব আমাদের জন্য নয়।’ পরভিন অত্যন্তই লাজুক। ক্যামেরার সামনে অস্বচ্ছন্দ বোধ করায় একগাল হেসে ফেলেন তিনি। ওই হাসির মধ্যে কত ব্যাথ্যা লুকিয়ে আছে, শুধু পরভিনই জানেন। তাঁর কথায়, বুকে নাকি পোকা হয়েছে (ব্লাড ক্যান্সার)। পোকায় খেয়ে নিয়েছে আধখানা বুক। জানেন না কতদিন বাঁচবেন। স্বামী চলে গিয়েছে অন্য কারোর সঙ্গে। চিকিৎসায় প্রচুর খরচ। পরভিন জানান, পুজোর বোনাসটুকুও জোটেনি। যাঁদের বাড়িতে কাজ করেন, তাঁরা পুজোয় ঘুরতে গিয়েছেন। বিজলি সিং থেকে পরভিন সকলেরই ভরসা জ্যোৎস্না বিবির ‘মাল’ কুড়োনোর রোজগার।
অদ্ভুত পরভিনের ছেলেবেলাও। মাত্র ১০ বছর বয়সে লোকের বাড়িতে কাজ করে ফেরার সময় ভুলবশত অনাথ ভেবে তাকে ধরে নিয়ে যায় হোমের লোকেরা। সেখানেই পরভিনের পরিচয় হয় তারই বয়সী আরেকটি অনাথ মেয়ের সঙ্গে। সেই মেয়েটির সঙ্গেই একদিন পালিয়ে যান হোম থেকে। বন্ধুটিকে নিজের বাড়িতেই আশ্রয় দেন। নিজের নামে তারও নাম দেন ‘পরভিন’। জ্যোৎস্না বিবি তাকে দেন মা ডাকার অধিকার, বিয়ে দেন ছেলের সঙ্গে। দুই পরভিন এখন থাকেন মিলেমিশে। প্রথম পরভিন বিশ্বাস করেন, তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানদের দায়িত্ব নেবেন দ্বিতীয় পরভিন। কারণ, বন্ধুটিকে নিজের নাম, ঘর, সংসার সব দিয়েছেন। কথা বলতে বলতে ‘বুর্জ খলিফার’ লেজার আলোর ছিটে ফের বাস্তবে ফিরিয়ে দেয় পরভিনকে। সন্ধে নেমেছে। এক চিলতের ঘরে নিভু নিভু আলোয় মিশে যায় পরভিন। আঙিনায় ভিড়ের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে তখনও ব্যস্ত সাদ্দাম আর সুরজমল।
আরও পড়ুন: আঁধারে পুজো: বন্যায় ভেসে কলকাতায় ভিরেছে ওরা, ‘মাকে’ কাঁধে না তুলতেই ১০ হাজার টাকা চাঁদা!