AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

আঁধারে পুজো: বন্যায় ভেসে কলকাতায় ভিরেছে ওরা, ‘মাকে’ কাঁধে না তুলতেই ১০ হাজার টাকা চাঁদা!

Durga Puja 2021:সারা রাজ্য যখন পুজোর কেনাকাটায় ব্যস্ত সেই সময় তারা বিশাল বিশাল প্রতিমা ঘাড়ে তুলছেন দুটো পয়সার মুখ দেখবে বলে। মণ্ডপে প্রতিমা পৌছে দিয়ে ষষ্ঠীর দিন সারা শরীরে কালশিটে আর সামান্য কিছু পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দেবেন সস্তার নতুন জামা, উৎসবের দিনে জোগাবেন পেটের ভাত।

আঁধারে পুজো: বন্যায় ভেসে কলকাতায় ভিরেছে ওরা, 'মাকে' কাঁধে না তুলতেই  ১০ হাজার টাকা চাঁদা!
Follow Us:
| Updated on: Oct 10, 2021 | 5:50 PM

শুভেন্দু দেবনাথ: “আমরা গ্রামের লোক, কোথায় শহরের লোক সাহায্য করবে, তা নয় এখানে তো উল্টে শহরের লোক আমাদের মতো গ্রামের লোককে চুষছে।” কথা বলতে বলতে তেড়ে ওঠেন তপন সর্দার। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নাজাট থানার রাজবাড়ির বাসিন্দা তপন আরও প্রায় জনা ৪০ লোকের সঙ্গে কলকাতায় এসেছেন কুলির কাজে। দ্বিতীয়া থেকে ষষ্ঠী, কুমোরের গোলা থেকে ভারি ভারি প্রতিমা ঘাড়ে করে প্রথমে লরিতে তোলা, তারপর মণ্ডপে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। বারোয়ারি প্রতি চুক্তি তিন থেকে চার হাজার টাকা। দ্বিতীয়া থেকে যে সাতদিন তারা প্রতিমা তোলার কাজ করবেন, সেই সব টাকা একত্রিত করে, ভাগ হবে ৪০ জনের মধ্যে। মাথা পিছু রোজগার হবে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা।

চলতি ভাষায় এদের বলা হয় কুলি। তপনদের ৪৩ জনের দলটি এসেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নাজাট থানার রাজবাড়ি গ্রাম থেকে। তপনের কথায় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একেবারে শেষ বর্ডার। ৪৩ জনই একই গ্রামের বাসিন্দা। এদের কেউ মাঠে কাজ করেন, কেউ বা পুকুরে জেলের কাজ করেন। জমি জায়গা বা পুকুর কারও নেই। অন্যের জমি বা পুকুরে কাজ করেন তারা। তপনদের দলে এবার দক্ষ কুলির চেয়ে প্রথমবার কাজ করতে আসা কুলির সংখ্যাই বেশি। কারণ পুজোর মুখে বৃষ্টিতে খেত-খামার, পুকুর সব ভেসে গিয়েছে। কাজ নেই গ্রামের অধিকাংশেরই। তপনের কথায় নেহাত রেশনে ২ টাকা কেজি চাল মেলে, তাই কোনও মতে চলে যাচ্ছে দিন।

এবারই প্রথম কুলির কাজে এসেছে বছর একুশের পিন্টু দাস। পড়াশুনা তেমন একটা হয়নি অভাবের সংসারে। বাড়ির এক ছেলে, সংসারের জোয়াল টানতে সারা বছর অন্যের পুকুরে কাজ করে পিন্টু। কেনও এসেছ জিজ্ঞাসা করাতে লাজুক পিন্টুর জবাব, ‘কী করব! পুকুরের সব মাছ ভেসে গিয়েছে। গ্রামের খেতে কোমর সমান জল। কাজ নেই।’ কেমন লাগছে কলকাতা? কলকাতা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে পিন্টুর। নাগেরবাজারের আরএন গুহ রোডে বিল্ব পালের গোলায় বসে পিন্টু জানায়, এলাকার এক বারোয়ারি তাদের কাছে দশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে। পিন্টু জানায় ‘জীবনে একসঙ্গে ১০ হাজার টাকা চোখেই দেখিনি। ক’টাকাই বা রোজগার হবে এখান থেকে।’ পিন্টুকে থামিয়ে দিয়ে তেড়ে ওঠে তপন। প্রতিমা তুলে কাঁধে ‘আব’ হয়ে গিয়েছে। তা দেখিয়ে বলে, ‘আমাদের কিছুই নেই। ষষ্ঠীর দিন এখান থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে তবে ছেলেমেয়ে, মা আর পরিবারকে জামা প্যান্ট কিনে দিতে পারব। এগারো বছর আগে সেই যে আয়লা দিয়ে সমস্যার শুরু হয়েছে, তা থামার নামই নেই। এখন মাঠে কোমর সমান জল। বন্যায় সময় বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার সময় লুঠ হয়ে গিয়েছে জিনিসপত্রও।’ সরকার সাহায্য করেনি? ‘এলাকার নেতা মন্ত্রী সাহায্য করা তো দূর, এসে আমাদের পরিস্থিতি দেখে এক দু হাজার টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেননি। সবই চলছে ভাইজান আর তার দলের লোকের দয়ায়। ইচ্ছে হলে দেখবেন, না হলে নয়। সবই মনমর্জি”।

চারদিনের দুর্গাপুজোয় জড়িয়ে থাকেন বহু মানুষ। মূর্তি গড়ার শিল্পী থেকে শুরু করে মায়ের সাজের শোলার কারিগর, ঢাকি, মণ্ডপ শিল্পী আরও কত জন। আলোয় আলোয় সেজে ওঠে মণ্ডপ থেকে শুরু করে রাস্তা ঘাট। সুসজ্জিত মণ্ডপে বিশাল বিশাল প্রতিমা দর্শনে ভিড় জমান আপামর বাঙালি। কিন্তু প্রদীপের নীচেই থাকে অন্ধকার। কারও মনে একবারও প্রশ্ন জাগে না এই এত বিশাল বিশাল প্রতিমা সেই কুমোরের গোলা থেকে মণ্ডপ অবধি পৌঁছল কী করে? কারা বয়ে আনল। ভাল প্রতিমা গড়লে পুরস্কার পান প্রতিমা শিল্পী, দুর্দান্ত মণ্ডপ গড়ে গলায় মেডেল ঝোলান মণ্ডপ শিল্পী, আলোর কাজে চমকে দিয়ে সেরার খেতাব জিতে নেন আলোর কারিগর। কিন্তু এদের কথা কেউ বলেন না। মণ্ডপে মণ্ডপে ঝোলানো ব্যানারে নাম থাকে আলোক শিল্পী থেকে প্রতিমা শিল্পী সকলের, কিন্তু এদের নাম কোথাও থাকে না। এরা অবশ্য কেউই শিল্পী নন, এদের হাতের জাদুতে মোহিত হওয়ারও তাই কেউ নেই। এরা নীচু তলারও নীচে বসবাস করেন।

সারা রাজ্য যখন পুজোর কেনাকাটায় ব্যস্ত সেই সময় তারা বিশাল বিশাল প্রতিমা ঘাড়ে তুলছেন দুটো পয়সার মুখ দেখবে বলে। মণ্ডপে প্রতিমা পৌছে দিয়ে ষষ্ঠীর দিন সারা শরীরে কালশিটে আর সামান্য কিছু পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দেবেন সস্তার নতুন জামা, উৎসবের দিনে জোগাবেন পেটের ভাত। এদের কথা কেউ ভাবে না। এদের না আছে জমি না আছে পুকুর। পরের জমিতে, পরের পুকুরেই জন খাটে তারা। সরকারও বন্যায় সব ভেসে গেলে ক্ষতিপূরণ দেয় জমি-পুকুরের মালিককে। এদের ভাগ্যে জোটে শুধুই অন্ধকার। এরা আসলে অন্ধকূপের বাসিন্দা, এরা বাসিন্দা ‘নেই রাজ্যের’।

আরও পড়ুন: Durga Puja 2021: মহম্মদের হাতে তিল তিল করে গড়ে ওঠে দুর্গা প্রতিমা, এ বিদ্যে শিখেছিলেন ‘ঈশ্বরের’ কাছে