গোঘাট, ধূপগুড়ি ও বর্ধমান: গ্রামীণ সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ দরিদ্র পরিবারের মানুষরা চিকিৎসার জন্য নির্ভর করে থাকেন এই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির উপরেই। যাঁদের বেসরকারি হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি করার উপায় নেই, আর্থিক সামর্থ নেই… তাঁদের ভরসা এই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিই। কিন্তু কতটা পরিষেবা পান তাঁরা এখান থেকে? খোঁজখবর নিতে একাধিক জেলায় একাধিক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে দেখলেন টিভি নাইন বাংলার প্রতিনিধিরা। বাস্তব চিত্র দেখা গেল, পুরো ভিন্ন। ঠিকঠাক পরিষেবা পেতে গিয়ে নাকাল রোগী ও তাঁদের পরিজনরা। কোথাও দেখা গেল, নিয়মিত ডাক্তারবাবুই আসেন না। আবার কোখাও দেখা গেল বিনা পয়সায় চিকিৎসা পরিষেবা পেতে গিয়ে ওষুধ কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। আবার কোথাও দেখা গেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরের চত্বরে পড়ে রয়েছে মদের বোতল।
যেমন হুগলির নকুণ্ডা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। গোঘাটের প্রত্যন্ত গ্রাম নকুন্ডা। শুধু এই গ্রামই নয়, আশপাশের আরও ২০-২৫টি গ্রামের দরিদ্র মানুষজন নির্ভরশীল এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর। কিন্তু সেখানে ডাক্তারবাবু মাত্র একজনই। তাও তিনি সপ্তাহে রোজ বসেন না। সপ্তাহে তিন দিন করে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বসেন তিনি। ডাক্তারবাবু ছাড়া সেখানে রয়েছেন একজন নার্সিং স্টাফ ও একজন ফার্মাসিস্ট। সপ্তাহের বাকি দিনগুলি ডাক্তারবাবুর অনুপস্থিতিতে নার্সিং স্টাফ ও ফার্মাসিস্ট মিলেও কোনওরকমে স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালান। আর ডাক্তারবাবু রোগী দেখার পর যেসব ওষুধ লিখে দেন প্রেসক্রিপশনে, তাও সবসময় পাওয়া যায় না স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কখনও মেলে। তবে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থেকে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে কিনতে হয় ওষুধ। এমনই অভিযোগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগী ও তাদের পরিজনদের। যদিও এই নিয়ে ওষুধ পেতে সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি সরকারি স্টাফরা। ব্লক মেডিসিন অফিসারও ক্যামেরার সামনে আসতে চাননি।
এদিকে অনেকটা একই ধরনের ছবি পূর্ব বর্ধমানের গলসির পুরসা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও। সেখানেও কার্যত বেহাল দশা। বিনামূল্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে গিয়ে গ্যাঁটের টাকা খরচ করতে হচ্ছে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের। ডাক্তারবাবুর লিখে দেওয়া ওষুধ, ইনজেকশন বা স্যালাইন… বেশিরভাগ সময়েই জোগান থাকে না। বাইরে থেকে কিনতে হয় সেসব জিনিসপত্র। রোগীর পরিজনদের অভিযোগ, সেখানে রোগী ভর্তি করলেই ওষুধ, ইনজেকশন, স্যালাইন বাইরে কিনে আনতে গিয়ে ৫০০-৭০০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ওই মানুষরা বলছেন, ‘নার্সিংহোমে যাওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে। কিছু ফ্রিতে হচ্ছে না। সব পয়সা লাগছে। এত পয়সা থাকলে তো বাইরে চিকিৎসা করাতাম।’ আর এসব নিয়েই তীব্র ক্ষোভ জমা বাঁধছে এলাকাবাসীদের মনে।
সমস্যার কথা একপ্রকার মেনে নিচ্ছেন সেখানকার চিকিৎসকরাও। কিন্তু তাঁরাও একপ্রকার অসহায়। গলসির পুরসা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক সায়ন জোয়ারদার বলছেন, রোগীর পরিজনরা রেগে যাচ্ছেন। তাঁদের ধৈর্য্য রাখতে হচ্ছে। গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে এই সমস্যা হচ্ছে। যদিও ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি তাঁদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না বলেও জানাচ্ছেন ওই চিকিৎসক। অভিযোগের কথা মানছেন সেখানকার বিএমওএইচ চিকিৎসক পায়েল বিশ্বাস। আশ্বস্ত করে তিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে জেলাস্তরে কথা হয়েছে এবং দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ধূপগুড়ির মেটেলি ব্লকের চালসা মহাবারি সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রেও কার্যত বেহাল অবস্থা। ছাদ চুইয়ে জল পড়ছে। গরমের মধ্যেই ঠিকঠাক ফ্যান ঘোরে না। হাতপাখাই সম্বল এখানে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আশপাশের চত্বরে মদের বোতল, গ্লাস পড়ে রয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত শৌচালয়ের ব্যবস্থাও নেই বলে অভিযোগ। যে গর্ভবতী মায়েরা এখানে আসেন, তাঁদের চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় বলে অভিযোগ। সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী গায়েত্রী মণ্ডলও। বলছেন, এই সমস্যা বহুদিন ধরে চলছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বিষয়টি জানানোর পরেও কোনও সমাধান হয়নি বলে অভিযোগ তাঁর।