পূর্ব বর্ধমান: শনিবার তখন রাত পৌনে ৮টা হবে। একটি সাদা বিলাসবহুল গাড়ি এসে থামে শক্তিগড়ে ল্যাংচা হাবের সামনে। দুধ সাদা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন চালক। ভিতরে তখন রাজুরা। আচমকাই সেই গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটি নীল রঙের গাড়ি। এরপর একের পর এক গুলি। চালকের আসনের পাশে বসে থাকা রাজু ঝা নামে এক কয়লা ব্যবসায়ী ঝাঁঝরা! সেই রাজু, (Raju Jha Murder Case) যাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ কয়লা পাচারের অভিযোগ রয়েছে ভূরি, ভূরি। এমনও শোনা যায়, তিনি নাকি কয়লা পাচারকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১১ সালের আগে কোলিয়ারি এলাকায় তাঁর দাপট ছিল বেসামাল। বিহারের ছেলে বাংলায় এসেছিলেন সেই কোনকালে। এক সময় কয়লার ট্রাকের খালাসি ছিলেন। খালাসি থেকে একদিন কালো হিরের ‘খিলাড়ি’ হয়ে উঠেছিলেন রাজু। বহু বিপদের পরোয়ানাকে এককালে ফুৎকারে উড়িয়ে কয়লার ‘কালো’ মসনদে বসেছিলেন যে রাজু, শনিবার সেই রাজুর দেহই হেলায় পড়েছিল জাতীয় সড়কের ধারে, সাদা গাড়িতে। শরীর ভাসছে রক্তে, বুলেটে ঝাঁঝরা বুক।
সন্ধ্যা তখন ৭টা ৪০ থেকে ৭টা ৫০ হবে। শক্তিগড়ের আমড়ায় এই খুনের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাদা ফরচুনা গাড়িতে ড্রাইভার-সহ চারজন ছিলেন। ড্রাইভার মুড়ি কেনার জন্য নেমেছিলেন। সেই সময় একটি নীল রঙের গাড়ি এসে সাদা ফরচুনা গাড়িটির পাশে দাঁড়ায় এবং সেই গাড়ি থেকে ২ জন নেমে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। ফরচুনায় সামনের সিটে বসে থাকা রাজু ঝা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন ব্রতীন মুখোপাধ্যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীল গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যায় আততায়ীরা।
পুলিশ জানিয়েছে, ফরচুনা গাড়ির ভিতর থেকে বেশ কয়েকটি গুলির খোল পাওয়া গিয়েছে। রবিবার ঘটনাস্থলে যায় ফরেন্সিক টিম। এদিনও একটি গুলির খোল পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে। আততায়ীরা গাড়িটি শক্তিগড় থানার কিছুটা আগে পুরনো জিটি রোডের উপর রেখে চম্পট দেয়। গাড়ি সুজুকি কোম্পানির বালেনো (Maruti Suzuki Baleno) মডেল। পুলিশ সূত্রে খবর, বালেনোর ভিতর থেকে পাঁচটি জাল নম্বরপ্লেট পাওয়া গিয়েছে।
শনিবারই পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপার বলেছিলেন, ফরচুনা গাড়িতে ড্রাইভার-সহ ৩ জন ছিলেন। একজন মারা গিয়েছেন, একজন আহত হয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তের স্বার্থে এর থেকে বেশি কিছু বলা যাবে না। রবিবার রাজ্য পুলিশের ১২ সদস্যর সিট গঠন হয়। যাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন।
এই মৃত্যু ঘিরে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে। সবথেকে বড় প্রশ্ন, পুলিশ বলছে, ঘটনার সময় তিনজন ছিল গাড়িতে। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, গাড়ির ভিতরে ছিলেন চারজন। সেই সেই চতুর্থ ব্যক্তি? টিভি নাইন বাংলার অন্তর্তদন্তে উঠে আসছে, এই চতুর্থ ব্যক্তি হতে পারেন আব্দুল লতিফ। রাজু শনিবার লতিফের সঙ্গে নিজের হোটেলে বৈঠক করেন বলেও সেই হোটেল সূত্রে জানা গিয়েছে। রাজু, লতিফ এবং ব্রতীন মুখোপাধ্যায় নামে আরও একজন একসঙ্গে বিকেলের পর হোটেল থেকে বেরিয়ে যান বলেও জানা গিয়েছে।
অন্যদিকে একটি ভিডিয়ো সামনে এসেছে এদিন। যদিও তার সত্য়তা টিভি নাইন বাংলা যাচাই করেনি। তবে দেখা গিয়েছে, যে গাড়িতে গুলি করা হয় রাজুকে, সেই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লতিফ। এদিকে লতিফকে তো সিবিআই খুঁজছে গরু পাচার মামলায়। তিনি ‘নিখোঁজ’ও তদন্তকারীদের হাতে। তাহলে কোথা থেকে এলেন লতিফ? সত্যি যদি তিনি লতিফই হন, তাহলে কী করছিলেন গাড়ির বাইরে?
ঘটনার রাতেই ওই চালক সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “আমরা দুর্গাপুর থেকে এসে শক্তিগড়ে মুড়ি খাওয়ার জন্য দাঁড়াই। এরপরই ফায়ারিং শুরু।” জানতে চাওয়া হয় গাড়িতে কারা ছিল, কোথায় যাচ্ছিলেন? খুব সন্তর্পণেই সেইসব প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি। থমথমে মুখ করে সরে যান সেখান থেকে। এই চালকের বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি। তবে এই গাড়ি যাঁর, তিনি যে তাঁরই কর্মী এমনটাই মনে করা হচ্ছে। তেমনটা হলে আর গাড়ির মালিক আব্দুল লতিফ হলে, এই চালক তাঁরই চালক হতে পারেন।
এই খুনের মোটিভ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে। ৩ এপ্রিল কয়লা পাচার মামলায় দিল্লিতে ইডি তলব করেছিল রাজেশ ওরফে রাজু ঝাকে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, অনেক যবনিকা তাঁর হাত ধরে উঠতে পারত। শুধু কয়লা নয়, লতিফের সঙ্গে তাঁর যোগে প্রশ্ন উঠছে, গরু পাচারের বিষয়েও কি রাজু কিছু জানতেন? প্রাক্তন সিবিআই আধিকারিক উপেন বিশ্বাস এ নিয়ে বলেন, আততায়ীরা খুবই পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। রাজু মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে গেলে মামলা ধাক্কা খেতে পারত বলেও মত তাঁর। গোটা প্রক্রিয়া ২ মাসের বেশি সময় ধরে পরিকল্পনা করে করা হয়েছে বলেও মনে করছেন তিনি।
প্রাক্তন পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, “অনুব্রত মণ্ডলের ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম শক্তিগড়ে এসে নির্দিষ্ট দোকানে নামছেন। দলের লোকজন আলোচনা করে নিচ্ছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন। আবার এখানেই দেখলাম রাজু ঝায়ের গাড়ি থামল, মেরে দিল। আমার তো মনে হচ্ছে, এই জায়গাথেকে অপরাধীদের কিছু অপারেশন, ষড়যন্ত্র চলছে। এটা তদন্ত করে দেখা দরকার।”