পূর্ব মেদিনীপুর: পঞ্চায়েত ভোট ও হলদিয়া পুর নির্বাচনের আগে পূর্ব মেদিনীপুর (Purba Medinipur) জেলায় বিশেষ নজর তৃণমূলের (TMC)। শুভেন্দু-গড়ে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষকে (Kunal Ghosh)। দলীয় সূত্রে খবর, জেলা ও ব্লক কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব রয়েছে তাঁর উপর। দায়িত্ব পাওয়ার পর ইতিমধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় পৌঁছে গিয়েছেন কুণাল। তৃণমূল দলে বর্তমানে ঘোষিত কোনও পর্যবেক্ষক পদ নেই। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাই জেলার সংগঠন সামলান। সেক্ষেত্রে, কুণাল ঘোষের এই সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব খানিক পর্যবেক্ষকের কাজের মতোই। কেন কুণাল ঘোষকে এই দায়িত্বের বেছে নেওয়া হল? শুভেন্দু অধিকারীকে কি ভয় পাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস? কুণাল ঘোষ অবশ্য এমন তত্ত্ব একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাফ বক্তব্য, “ভয়ের কোনও বিষয় নেই। কে শুভেন্দু?”
প্রসঙ্গত, বর্তমানে তৃণমূলের সাংগঠনিক স্তরে কোথাও কেউ এমন দায়িত্বে নেই। কেবল পূর্ব মেদিনীপুরেই কেন এমন দায়িত্ব? আর কুণাল ঘোষকেই বা কেন বেছে নেওয়া হল?
কেন কুণাল ঘোষকে এই দায়িত্ব দেওয়া হল, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কুণাল ঘোষ। তিনি বলেন, “কিছু কিছু এলাকা আছে, যেখানে মিথ্যাচার, বাহুবল, অর্থবল, চক্রান্ত… এগুলি একটু বেশিভাবে করার কেউ কেউ চেষ্টা করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। এই যেমন শুভেন্দু। সেই জায়গায় আমাদের সংগঠনকরা খুবই ভাল কাজ করছেন। শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের সকলের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য আমায় বলেছে। যাতে একটু বাড়তি সময় দিই। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমায় যে নির্দেশ দিয়েছে, তা আমি দায়িত্ব নিয়ে পালন করব।”
কেন কুণাল ঘোষকে বেছে নেওয়া হল? জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি সুপ্রকাশ গিরির কথায়, “আগামী দিনে হলদিয়া পুরনির্বাচন রয়েছে, পঞ্চায়েত নির্বাচন রয়েছে। নেতৃত্ব মনে করেছে একজন অভিজ্ঞ মানুষকে যদি রাখা যায়, কর্মীদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য, তাই কুণালবাবুকে এই জেলায় দায়িত্বে পাঠিয়েছে। জেলার নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ভাল। বিধানসভা নির্বাচনের আগে বা পরে বহুবার এসেছেন।”
কুণাল ঘোষের অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, কুণাল বাবু অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি সাংসদ ছিলেন। এখন দলের মুখপাত্র। রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পাদক। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সূত্রে হোক বা রাজনৈতিক সূত্রে হোক যুক্ত ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে।”
এর পাশাপাশি আরও একটি উদাহরণ তুলে ধরেন সুপ্রকাশ। শুভেন্দুর নাম না করে বলেন, “একজন ভয়ে সিবিআই-ইডি থেকে বাঁচতে চলে গিয়েছে। কুণাল বাবুকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি শিরদাঁড়া বিক্রি করেননি। তিনি দলে থেকে দলের হয়ে কাজ করেছেন। তাই কুণাল বাবুর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের কোনও একজন কলকাতার নেতৃত্ব এসে সংগঠন দেখভাল করুক।”
আগামী দিনে দলের জেলা স্তরে এই সেতুবন্ধনের কাজে কুণাল ঘোষের ভূমিকা নিয়ে কী ভাবছে জেলা নেতৃত্ব? সংগঠন কি আরও পোক্ত হবে এবার? জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি সুপ্রকাশ গিরি জানাচ্ছেন, “কলকাতার অভিজ্ঞ নেতৃত্ব তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সাংগঠনিক দেখভাল করার জন্য। সেই সঙ্গে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান, তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার কথাই নেই। আমরা খুবই আনন্দিত এমন অভিজ্ঞ নেতৃত্বকে আমরা পেয়েছি, যাঁর সাহায্যে সংগঠনকে আরও মজবুত করতে পারব।”
উল্লেখ্য, তৃণমূলের অন্দরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সাম্প্রতিককালে একাধিক বার দ্বন্দ্বের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। এবার কি কুণাল ঘোষের সেতুবন্ধনে সেই সমস্যা কিছুটা মিটবে? টিভি নাইন বাংলার প্রশ্নের উত্তরে সুপ্রকাশ গিরি জানান, “নিশ্চিতভাবে তিনি এই বিষয়ে চেষ্টা করবেন। কিন্তু এই জেলা একজন লিজ় নিয়েছিলেন। তাঁর কথা ছাড়া, তাঁর পরিবারের কথা ছাড়া এই জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা কোনও কথা রাখতে পারতেন না। কিন্তু তিনি দলের সঙ্গে বেইমানি করে চলে গিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই জেলায় তাঁরা দলে এই ধরনের কাজকর্ম চালিয়েছেন বলে সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছে। সেটিকে আমি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বলব না। কুণাল বাবু দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, প্রবীণ সাংবাদিক, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিশ্চিতভাবে সেগুলি মাথায় রেখেই দল যাতে আরও বেশি সংগঠিত হয়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
রাজনীতির আঙিনার পাশাপাশি কুণাল ঘোষের সঙ্গে গিরি পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পর্কও বেশ ভাল। সেক্ষেত্রে কি বাড়তি সুবিধা হবে গিরি পরিবারের? সেক্ষেত্রে কি জেলায় সংগঠনের রাশ কি গিরি পরিবারের হাতেই থাকবে? এমন সম্ভাবনা অবশ্য একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন সুপ্রকাশ গিরি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও রাজনীতিকে একসঙ্গে মেলাতে চাইছেন না তিনি। বললেন, “রাজনীতির ময়দানে যখন রাজনীতি করব, তখন ভাল-খারাপ নিশ্চিতভাবে তিনি বিচার করে দেখবেন। আমরা সকলে একসঙ্গে মিলে লড়ব। আমাদের মূল লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে।”
রাজ্যের মন্ত্রী তথা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের অন্যতম প্রধান মুখ অখিল গিরির সঙ্গেও কুণাল ঘোষের বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে যোগাযোগ করেছিল টিভি নাইন বাংলা। তিনি জানান, “উনি এর আগেও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অনেক কর্মসূচিতেই তিনি এসেছেন। কোনও অসুবিধা হবে বলে মনে করি না। তবে আমাদের জেলা সংগঠনেরও দায়িত্ব, কুণাল ঘোষকে সহযোগিতা করা। তাঁকে নিয়ে সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।”
তিনি আরও বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচন স্থানীয় সিনিয়র নেতারাই করাবেন। তাঁদের মধ্যে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, যাতে ঐক্যমত থাকে, সেই জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি তো আর প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে যাবেন না। পঞ্চায়েত নির্বাচন জেলা নেতৃত্বকেই দেখতে হবে। উপর থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এই সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে রাজ্য নেতৃত্ব।”
এদিকে শুভেন্দু অধিকারীর গড়ে তৃণমূল কুণালকে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়ায় প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতা বলেন, “এই রকম একজন নিকৃষ্টমানের লোক, যাঁর মুখ অবিলম্বে ব্লিচিং ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত। একটা লোক চুরির দায়ে সাড়ে তিন বছর জেলে ছিল। প্রতিষ্ঠিত চোর। তাঁর সম্পর্কে কেন বলান আমাকে? আমার আমার কোনও গড় নেই। আমি ভারতবাসী, সনাতন সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি। ভারতই আমার গড়। আমার নির্দিষ্ট কোনও গড় নেই।”