পূর্ব মেদিনীপুর: ব্রিটিশ শাসনের ভারত দেখেছেন তিনি। দেখলেন স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছরও। কোলাঘাটের ১০২ বছরের লক্ষ্মীবালা মাইতি সেই ‘টাইম মেশিন’, যাঁর হাত ধরে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় বীরগাঁথা লেখার সেইসব দিনে। সোমবার স্বাধীনতা দিবসে তাঁর হাতেই উঠল স্বাধীন ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। পতপত করে যখন আপামর দেশবাসীর গর্ব-গরিমা উড্ডীন, শতায়ু লক্ষ্মীবালার দু’চোখ তখন খানিক ছলছল। বুঝি বা মনে পড়ে গেল, স্বাধীনতা আনার সেই দিনগুলো। কত রক্ত, কত লড়াই, কত বলিদানের বিনিময়ে হাজার হাজার ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী, প্রীতিলতারা এই সূর্য ওঠা ভোর এনে দিয়েছিলেন সেদিন। সেসব তো চাক্ষুষ করেছেন রূপনারায়ণের পারের লক্ষ্মীবালা।
১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হল, ততদিনে লক্ষ্মীবালার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কোলাঘাটের এক কৃষক পরিবারের বউ তিনি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ জেলার অবদান কে না জানে। লক্ষ্মীবালা তখন যুবতী। ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচার, স্বাধীনতা আন্দোলন, ভারতীয়দের শিকল ভাঙার পণ, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার-এখনও চোখের সামনে ভাসে তাঁর। অনেক কিছুই ঝাপসা হয়েছে স্মৃতি থেকে। তবে ভোলেননি গর্জে ওঠার সেসব দিনগুলো।
এখন লক্ষ্মীবালার ভরা সংসার। ছয় ছেলেমেয়ে, আঠারো নাতি নাতনি, সাত নাতজামাই, সাত নাতবৌয়ের মাথার উপর এখনও বটবৃক্ষ তিনি। মুখের চামড়া কুচকে গিয়েছে বয়সের ভারে। কিছুটা ন্যুব্জও হয়েছেন। দাঁতের পাটি ফাঁকা হয়েছে বহুদিন হল। কিন্তু এখনও বেশ টট্টরে। বিশ্রাম নেওয়ার কথা শুনলেই বলেন, “ভাল লাগে না। কাজ করতেই ভাল লাগে।” কোলাঘাট নতুন বাজারে সবজি বিক্রি করেন এখনও।
গল্প শোনান, ‘ওলাউঠো লালমুখো’দের। ছ্যাঁকা ধরানো বাজারে বসেই টুকটুক করে গল্প করেন, সেইসব দিনের। যখন ১৬ আনায় পাওয়া যেত রূপনারায়ণের ১৬টি ইলিশ, ৭ আনায় একমন ধান, ৩ টাকায় সোনার নাকফুল, দিনভর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটে আয় হত ২ আনা। এই মানুষগুলোই তো সেতু। যাঁদের দর্পণে অতীতকে দেখবে বর্তমান।
কোলাঘাটের এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার ৭৫ বছরে লক্ষ্মীবালা মাইতিকেই নিয়ে এসেছিলেন পতাকা উত্তোলনের জন্য। সোমবার সকালে কোলাঘাট রাধামাধব মন্দিরে লক্ষ্মীবালাকে চন্দন, উত্তরীয়, ফুলের মালায় বরণ করে নেওয়া হয়। তাঁকে সুন্দর করে সাজানো একটি পালকিতে বসিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়। চার বেহারার পালকিতে লক্ষ্মীবালা। সাদা পাটভাঙা শাড়ির ঘোমটার আড়াল থেকে দেখছেন চারদিক। বাইরে তখন দেশমাতৃকার জয়ধ্বনি, উড়ছে ত্রিবর্ণ পতাকা।
সংস্থার তরফে শ্যামল আদক বলেন, “স্বাধীনতার বয়স হল ৭৫। আর যিনি এদিন পতাকা তুললেন তাঁর বয়স ১০২ বছর। যেদিন দেশ স্বাধীন হল সেদিন উনি ২৭ বছরের এক যুবতী। এমন একজন মানুষ আমাদের সামনে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন, ভাবলেই একটা কেমন যেন অনুভূতি হয়। উনি স্বনির্ভর এখনও। নিজে উপার্জন করেন। উনি সত্যিই আদর্শ।”
আরও পড়ুন: 19,867.8 MHz স্পেকট্রাম অধিগ্রহণ করে ভারতীয়দের জন্য 5G বিপ্লব ঘটাতে চলেছে এয়ারটেল