দার্জিলিং: পঞ্চম দফা নির্বাচনে যখন উত্তপ্ত বাংলা তখন যেন বেশিই নিস্তব্ধ পাহাড় (darjeeling)। উত্তরবঙ্গে ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তাপ সেভাবেও যেন এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু, শীতল যুদ্ধে পিছিয়ে নেই পাহাড়ের দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ। বিনয় তামাং ও বিমল গুরুং। একদিকে নিয়ম মেনে ঠিক দুপুর দেড়টায় ভোট দিলেন বিনয়, তখন, অন্যদিকে, তিন বছর পর সস্ত্রীক ভোট দিলেন বিমল গুরুং (Bimal Gurung)।
শনিবার, ব্লুমফিল্ড প্রাইমারী স্কুলের বুথে ভোট দিয়ে বেরনোর সময়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে যান বিনয় তামাং (Binay Tamang)। তখন কেন্দ্রীয় বাহিনী তাঁকে বাধা দিলে উভয়পক্ষে বচসা শুরু হয়। জওয়ানদের উদ্দেশে বিনয় বলেন, ”আমি তো মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছি। আমায় কথা বলতে দিন।” বচসার জেরে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়। বিনয় এ দিন বিমল গুরুংকে সরাসরি নিশানা করে বলেন, ”বিমল গুরুং মোটেও কোনও ফ্য়াক্টর নয়। তবে তিনি আমার কাছে চ্যালেঞ্জ।” বিনয় এ দিন অভিযোগ করেন, বিজেপির (BJP) সঙ্গে গোপন আঁতাত রয়েছে বিমলের। এমনকী, গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে গোপন বৈঠকও সারছেন তিনি। যদিও এই অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছেন বিমল।
প্রায় তিন বছর পর পাহাড়ে ফিরে ভোট দিতে পেরে আপাতত স্বস্তিতে বিমল। ভোট দেওয়ার পরেই নিজের পুরনো সঙ্গী বিজেপিকে (BJP) নিশানা করেন গুরুং। ভোট দেওয়ার পরই গুরুং বললেন, ‘বাংলায় BJP-র সমর্থন নেই।’ তিনি আরও বলেন, ”গ্রাউন্ড জিরোতে BJP-র কোনও প্রভাব নেই। কীভাবে সরকার গড়বে তারা? হিংসা, অশান্তি, গুলি দিয়ে রাজনীতি ঠিক নয়। রাজনীতি আরও সহজ সরল হওয়া উচিত।”
They (BJP) don’t have people’s support in Bengal. They don’t have much influence on ground zero. How can they form the government? Politics is not possible through violence, vandalism, shooting. Politics should be simple: GJM (Gorkhaland Janmukti Morcha) leaders Bimal Gurung pic.twitter.com/wOBGnPw7Sj
— ANI (@ANI) April 17, 2021
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে পাহাড়ে অশান্তির সময়ে বিমল গুরুংয়ের নামে একাধিক ধারায় মামলা হয়। তারপরেই পাহাড় ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যান তিনি। ফলে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তিনি ভোট দিতে পারেননি। তবে ওই নির্বাচনে গুরুংয়ের সমর্থন ছিল বিজেপির দিকে। তবে এবার পরিস্থিতি অন্যরকম। গুরুং পাহাড়ে ফিরে ফের রাজনীতিতে সক্রিয়। বিজেপি নয়, তৃণমূলকে (TMC) সমর্থন করছেন তিনি।
গোর্খা জনমুক্তির মোর্চার দুই শিবির আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত। দুই শিবিরই তিন কেন্দ্রে আলাদা আলাদা ভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অপরদিকে মোর্চার এই ফাটলের সুযোগে শক্তি বাড়িয়েছে জিএনএলএফ। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। সভা করে গেছেন অমিত শাহ নিজেই। অন্যদিকে, তৃণমূলের অবস্থান ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। যুব তৃণমূল সমর্থন দিয়েছে মোর্চার বিনয় তামাং শিবিরকে এবং মূল তৃণমূলের সমর্থন বিমল গুরুংয়ের দিকে। সাড়ে ৩ বছরের বেশি অজ্ঞাতবাসে থাকার পরে ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে আচমকা আর্বিভাব হয় বিমল গুরুংয়ের। পাহাড়ের রাজনীতিতে গুরুংয়ের এই প্রত্যাবর্তন কোনওমতেই মেনে নিতে পারেন জিটিএ প্রধান তথা মোর্চার অপর শিবির বিনয় তামাং, অনিত থাপারা।
এবারের নির্বাচনে তাঁরা আলাদা ভাবে প্রার্থী দিয়েছেন। অপরদিকে পাহাড়ে পা রেখে নিজের গড় ধরে রাখতে মরিয়া বিমল গুরুং। একসময়ে বিজেপির সঙ্গে থাকা গুরুং এবারের নির্বাচনে সমর্থন দিচ্ছেন তৃণমূলকে। তামাং শিবিরকে টেক্কা দিতে এবারও তারা আলাদা ভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ৩ আসনেই প্রার্থী দিয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে, শেষ কয়েকমাসে মোর্চার অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে পাহাড়ে শক্তি বাড়িয়ে চলেছে জিএনএলএফ। পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় মিটিং -মিছিল করছেন এতোদিন তারা। এবার তারা সমর্থন দিচ্ছেন বিজেপির প্রার্থীদের। ৩ আসনেই প্রার্থী প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। যদিও প্রার্থী দেওয়া নিয়ে প্রথমে জিএনএলএফের সঙ্গে মতানৈক্য হয়েছিল বিজেপির। তবে পরে সেই সমস্যা মিটে যায়। অমিত শাহ নিজে এসে সভা করেছেন পাহাড়ে।
প্রসঙ্গত, তৃণমূলের সমর্থন থাকলেও পাহাড়ে একসঙ্গে প্রচার নয় বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন মোর্চা নেতা বিনয় তামাং। বৈঠকে তিনি জানান, মংপু থেকে পাহাড়ের তিনটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। সেদিন ইস্তাহারও প্রকাশ করে পুরোদমে প্রচার শুরু হবে। কিন্তু দল পাহাড়ে একাই প্রচারে নামবে। বিনয়ে কথায়, ‘‘আমাদের তৃণমূলের সঙ্গে জোট রয়েছে। তাই তৃণমূল তিনটি আসনে লড়ছে না বলে জানিয়েছে। এখানে আমরা আমাদের মতো করেই প্রচার, ভোট পরিচালনা করব।’’ বিনয় ও বিমল শিবিরের তরফে আলাদা প্রার্থী দেওয়া প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় এ বার পাহাড়ে অনেকদিন পর জোরদার ত্রিমুখী লড়াই।
পাহাড়ের রাজনৈতিক দলের নেতাদের একাংশের দাবি, প্রার্থী তালিকা ঘোষণার দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) জানিয়েছিলেন, পাহাড়ের বন্ধুরা তিনটি আসনে লড়বেন। যাঁরা জিতবেন তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গেই থাকবেন। এতে পরিষ্কার যে, দুই গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে লড়াই করে, শক্তি পরীক্ষা দিয়ে জিতে আসুক, তাই বলতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। এই অবস্থায় ত্রিমুখী লড়াই হলেও মোর্চার ভোট দুই গোষ্ঠীতে ভাগ হয়েছে।
বিনয়পন্থীরা জানান, পাহাড়ের আন্দোলনের সময় সিংহভাগ মানুষ তৃণমূলের বিপক্ষে ছিলেন। গুলি ও একাধিক মৃত্যুর ঘটনায় তৃণমূল পাহাড়ে সমস্যায় পড়েছিল। রাজ্যের শাসক দলকে সেই সময় অনেক কিছুই শুনতে হয়েছে। পরে বিনয়েরা গুরুং থেকে আলাদা হয়ে এলেও তৃণমূলকে (TMC) পাহাড় ভাল চোখে নেয়নি। পাহাড়ের ঘাসফুল নেতারা বসেও গিয়েছিলেন। দু’বছর ধরে ফের পরিস্থিতি ধীরে পাল্টালেও তৃণমূল নিয়ে একাংশের ছুৎমার্গ রযেইছে। তাই বিনয়েরা তৃণমূলকে ‘দূরে’ রেখেই নামছেন। যদিও, এই সমস্ত ধারণাই উড়িয়ে দিয়েছেন খোদ বিনয় তামাং। তাঁর দাবি, বরাবরই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন, দিদির সঙ্গেই থাকবেন। কিন্তু বিমলের সঙ্গে সন্ধিতে নারাজ বিনয়। তাই পঞ্চম দফার নির্বাচনে পাহাড় কে দখল করবে তা নির্ধারণ হবে ২মে।
আরও পড়ুন: ‘শীতলকুচি নিয়ে কোনও ভুল বলিনি,’ অডিয়ো ক্লিপ নিয়ে সাফাই মমতার