পশ্চিমবঙ্গ: একুশের বিধানসভা ভোটে (West Bengal Assembly Election) তৃণমূল (TMC) ও বিজেপি (BJP), যুযুধান দুই পক্ষই মতুয়া (Matua) ভোটকে টানতে মরিয়া। একদিকে বাংলাকে পাখির চোখ করা অমিত শাহ (Amit Shah)-রা মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) জানাচ্ছেন মতুয়াদের আলাদা করে নাগরিকত্বের প্রয়োজন নেই। তাঁরা এ দেশেরই নাগরিক। প্রতিটি ভোট আবহে মতুয়া ফ্যাক্টর ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু মতুয়া কারা? কেন বঙ্গভোটের রাজনীতিতে তারা আলাদা করে নজর কাড়ে রাজনৈতিক দলগুলির।
মতুয়া কারা?
মতুয়া হল সনাতন হিন্দুধর্মের একটি বিশেষ সম্প্রদায়। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার নিবাসী হরিচাঁদ ঠাকুর প্রেমভক্তিরূপ ধারাকে গতিশীল করতে যে সাধন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন, তাই পরিচিত হয় মতুয়াবাদ বলে। ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে ১৮১২ সালের ১১ মার্চ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম। বৈষ্ণব বাড়িতে জন্ম নেওয়া হরিচাঁদকে স্থানীয় জমিদারের জন্য পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হয় ৪০ কিলোমিটার দূরে ওরাকান্দিতে। সেখানেই ক্রমে হরিচাঁদের মতবাদে বহু মানুষ আকৃষ্ট হন। তাঁর অনুগামীরা বিশ্বাস করেন হরিনাম জপেই উচ্চ শ্রেণির অত্যাচার থেকে মিলবে মুক্তি। তবে উচ্চবর্ণের হিন্দু অথবা যাঁরা আদি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত তাদের সঙ্গে হরিচাঁদ ঠাকুরের দূরত্ব রয়েছে। তারা খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হরিচাঁদ অনুগামীদের মতো বলে ডাকতেন। এই শব্দটিকেই হরিচাঁদ বেছে নেন তাঁর অনুগামীদের নামকরণে। সেখান থেকেই মতুয়া-র উৎপত্তি।
মতুয়া সম্প্রদায়:
১৮৭৮ সালে হরিচাঁদের মৃত্যু হয়। এর পর তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই বিশেষ সম্প্রদায় এগিয়ে চলে। মতুয়ারা একইসঙ্গে বৈষ্ণব ও হিন্দুধর্মকে অনুসরণ করে। তবে তাঁরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। বৈদিক ক্রিয়া-কর্মে তাঁরা আস্থাশীল নন। মতুয়াদের বিশ্বাস, ভক্তিতেই মুক্তি। মতুয়া সাধন পদ্ধতির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ তাঁদের মূল দর্শন। আর মতুয়া ধর্মপ্রচারকদের বলা হয় গোঁসাই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ এই ধর্মের প্রচার করতে পারে। তাঁরা বর্ণপ্রথার বিরোধী, মানবতায় বিশ্বাসী। নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান অধিকার দেওয়াতে এঁরা বিশ্বাসী।
মতুয়া দর্শন:
ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী এই সম্প্রদায়ের মতবাদে বাল্য বিবাহের তীব্র বিরোধিতা যেমন আছে তেমনি রয়েছে বিধবা বিবাহে পূর্ণ সমর্থন। কীর্তনের সময় এঁরা কাঁসর, জয়ডঙ্কা, শাঁখ, শিঙ্গা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। নিম্ন বর্ণ কৃষককদের দর্শন আদি শঙ্করাচার্য ও বৈষ্ণবদের থেকে আলাদা। মতুয়ারা বিশ্বাস করেন ব্রাহ্মণ্যবাদ হল শূদ্র ও নিম্নবর্ণকে পিছিয়ে এবং বাঁচিয়ে রাখার একটা প্রক্রিয়া। গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা এবং প্রচারে বহু নিম্ন বর্ণের মানুষকে আকৃষ্ট করে। তিনি বলতেন, “ক্ষিদে পেটে ধর্ম হয় না।”
প্রধানত কৃষিকাজই মতুয়া সম্প্রদায়ের পেশা। তাই পরিবারজীবন এঁদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ধ্বজা দুই রঙা- লাল ও সাদা। লাল হল রজঃশলা আর সাদা হল পবিত্রতার প্রতীক। মতুয়া সম্প্রদায়েরর মধ্যে বিবাহকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এ হেন মতুয়া সম্প্রদায় তৃণমূল ও বিজেপির কাছে ভোট রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব আদায় করে নিয়েছে।
ভোট রাজনীতি ও মতুয়া:
Tv9 Election Intelligence And Research Wing- এর সমীক্ষা অনুযায়ী এ রাজ্যে ৩৯টি বিধানসভা আসনে ২০ শতাংশের বেশি মতুয়া ভোট রয়েছে। এই আসনগুলি রয়েছে নদিয়া (১০টি ), উত্তর ২৪ পরগনা (৯), দক্ষিণ ২৪ পরগনা (১২টি) এবং পূর্ব বর্ধমান (৮টি) জেলায়।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রপৌত্র প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর প্রথম রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯৩০ সালে পিতামহ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর প্রমথ রঞ্জন মতুয়া সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। এই সময় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বঙ্গীয় আঞ্চলিক তফসিলি জাতি সংগঠন (বি.পি.এস.সি.এফ) স্থাপন করেন। উল্টো দিকে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর এর বিরোধী সংগঠন বঙ্গীয় আঞ্চলিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা বি.পি.ডি.সি.এল গঠন করেন। দুটি সংগঠনই দেশ-বিভাজনের বিষয়ের ক্ষেত্রে তীব্র রূপে একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। নিজ নিজ সংগ্রামে এই দুটি দলই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সারিবদ্ধভাবে কাজ করে গেছে। আর গুরুচাঁদ ঠাকুর বলতেন , যে রাজনৈতিক দল মতুয়াদের স্বার্থরক্ষা করবে তাঁরা তাদের পাশে থাকবেন। তবে গুরুচাঁদের জীবদ্দশায় কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়ায়নি মতুয়া সম্প্রদায়। প্রমথ রঞ্জনের সময় থেকে কংগ্রেস দলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে মতুয়া সম্প্রদায়ের।
আরও পড়ুন: করোনা টিকাকরণ শেষ হলেই সিএএ, মতুয়াদের শাহি আশ্বাস
অন্যদিকে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তথা সারা ভারত তফসিলি জাতি ফেডারেশনের মতো স্রষ্টা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে ঘিরে আরও একটি দল গঠন করা হয়েছিল। দেশ বিভাগের রাজনীতি শুরু হলে ফেডারেশন মুসলিম লীগের সাথে জোট বেঁধেছিল। যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের ধারণা ছিল যে বাংলাদেশের কৃষকরা হয় নমশূদ্র, দলিত বা মুসলমান। দুটি বিভাগের মধ্যে একটি সমন্বয় ঘটেছিল এবং অনুভূত হয়েছিল যে দলিত এবং মুসলমানরা মিলিতভাবে কাজ করতে পারে। সেই থেকে এদের একটি ভাগ কংগ্রেসের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং বাংলা ভাগের পর তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। অন্যদিকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলরা পূর্ব পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তিনি পাকিস্তানের ক্যাবিনেট মন্ত্রীও হন।
আরও পড়ুন: মতুয়া, রাজবংশী ও মুসলিমদের ভাঁওতা দিচ্ছেন মমতা: শান্তনু ঠাকুর
১৯৫০ সালের পর আবার এক পরিবর্তন ঘটে। পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে লাখ লাখ কৃষক পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। ১৯৫৬-৫৭ সাল থেকে সেই বিভাজনের রাজনীতির শুরু বলা চলে। এ পার বাংলায় রিফুউজি হয়ে থাকতেও সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। আন্দামানের একটা অংশে তাঁদের তাঁবু খাটিয়ে দিনপাত হয়। এর মধ্যে ১৯৬০ সাল নাগাদ নমঃশূদ্র কৃষকরা পুনর্বাসনের জন্য লড়াই শুরু করেন। তাতে নেতৃত্ব দেন প্রমথ রঞ্জন। অন্যদিকে এই আন্দোলনে ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। কিন্তু তাঁরা কখনওই একত্রে লড়াই করেননি। সে থেকেই এই বাংলার একটা অংশে বাস করেন মতুয়ারা। এবং ভোটের রাজনীতিতে অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছেন।