জলপাইগুড়ি : এক শরতে তাঁকে আবাহন করেছিলেন স্বয়ং শ্রীরাম, আর শীতে প্রতিবার জলপাইগুড়ির পণ্ডিত বাড়িতে আসেন তিনি। মা দুর্গার ষষ্ঠ রূপ তিনি। স্বয়ং মা কাত্যায়নী। গত ২০০ বছরের পরম্পরায় তিনি আসেন হেমন্তকালে।
করোনা আবহে জাঁক নেই তবে জমক আছে। সে জমক, পারিবারিক। বংশ পরম্পরার। অনুশাসন মেনেই ১৭ ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে পুজো(Puja)। ২০ ডিসেম্বর থেকে ষষ্ঠী। কাত্যায়নীই এখানে মা দুর্গা।
পুজোপচারের সাতকাহন
বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ কইলা গ্রাম থেকে আনা ভিটের মাটি দিয়ে গড়া মা কালীর থানে পঞ্চমী তিথিতে পাঠা বলি দিয়ে কালী পুজো করে শুরু হয় পুজোর(Puja) কাজ।
ষষ্ঠীর দিন মহা ধূমধামের সাথে প্রতিমা এনে বিল্বমূল দিয়ে মা দুর্গাকে আবাহন করে শুরু হয় পুজো। একইসঙ্গে দলবেঁধে শুরু হয় বাজার হাট করে তরিতরকারি কাটা। দুই ভাগে রান্না করে পরিবেশনে হাত লাগান বাড়ির মহিলারা।
সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত কয়েকশ’ যজমান সহ কয়েক হাজার শহরবাসী ,আত্মীয়রা পুজো দিয়ে পাত পেড়ে প্রসাদ খেতে আসেন। এবারে, করোনার কারণে সেই প্রসাদ ‘প্যাকেটে’ পরিণত।
চতুর্ভুজা এই প্রতিমা দশমীর পর বিসর্জন হয়না। প্রতিমা রাখা থাকে পণ্ডিত বাড়ির নাটমন্দিরে। বছরভর দুই বেলা ভোগ দিয়ে পুজো হয়।
ইতিহাসের পথে …
বাড়ির সদস্য বিপ্লব বাবু জানান, তাঁরা বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ কইলা গ্রামের আদি বাসিন্দা। পৌরহিত্যই তাঁদের পেশা। তাই বছরভর বিভিন্ন পূজো অর্চনা, বিয়ে,মুখেভাত বা আদ্যশ্রাদ্ধ নিয়ে যজমানি ব্যস্ততায় দিন কাটে। অন্তত ২০০ বছর আগে পূর্বপুরুষেরা পুঁথি ঘেটে হেমন্তকালে এই পুজোর প্রচলন করেন।সেই থেকে দুর্গাপুজো বলেই পরিচিত এই পুজো।
এরপরে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে বিপ্লব বাবুর পিতামহ রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও তাঁর এক ভাই যোগেশচন্দ্র ভট্টাচার্য জলপাইগুড়ি রায়কত পাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকার পৈতৃক ভিটের থেকে মাটি নিয়েএসে তা দিয়ে এই বাড়িতে মা কালীর ভিত স্থাপন করেন। সেখানে কালীপুজোর পর দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন যা আজও চলে আসছে। কালী পুজোয় বলি হয়। কিন্তু ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে নিরামিষ। বিসর্জনের পর মাছ ভক্ষণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘আত্মীয় সমাগমের পাশাপাশি এই পুজোর মাধ্যমে যজমান বাড়িগুলির সঙ্গে একটা সু সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করা একটি মূল উদ্দেশ্য। পুজো উপলক্ষে প্রতিদিন বাড়িতে দুই বেলা মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ লোক পেটপুরে খিচুড়ি, লাবড়া,চাটনি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি খাওয়া দাওয়া করে। পুজোর মূল খরচ পরিবারই বহন করে। এছাড়া, যজমানরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।’
বাড়ির বড় বৌ গোপা ভট্টাচার্য জানান এই কয়দিন বাড়ির সবাই মিলে কাজে হাত লাগিয়ে তরকারি কাটা থেকে ভোগ রান্না পরিবেশন করা সবই অন্দরমহলের দায়িত্ব। তবে করোনার জন্য এবছর সবই বন্ধ।তবে, পুজোতে ইছাপুর থেকে ছুটে এসেছেন বাড়ির ছোট মেয়ে রঞ্জনা ভট্টাচার্য। পুজোর আনন্দ ‘মিস’ করতে তিনি অপারগ।
আরও পড়ুন: অধিকারী বাড়ির সামনে দিয়ে তৃণমূলের মিছিল, স্লোগান উঠল ‘মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতক’
মূলত, পুরোহিত- যজমান সম্পর্ক সুদৃড় করতে বাংলাদেশ থেকে গত তিন পুরুষ ধরে মা কাত্যায়নী কে দুর্গোৎসব বিধানে পুজো করে আসছে জলপাইগুড়ি রায়কত পাড়ার পণ্ডিত বাড়ির ভট্টাচার্য পরিবার।পুজো উপলক্ষে ষষ্ঠী থেকেই আত্মীয়রা আসা শুরু করেন পন্ডিত বাড়িতে। আসেন অন্য জেলার যজমান পণ্ডিতরাও। কিন্তু করোনার প্রকোপে এবার হাতে গোনা কয়েকজন এসেছেন ভিন জেলা থেকে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর দশমীতে শেষ হবে পুজো।