রিয়াধ: হাসপাতালে নতুন চাকরি পাওয়ার পরই রিয়াধের এক সালোঁয় চুলের এক নতুন ছাঁট দিতে গিয়েছিলেন সফি। পেশায় ডাক্তার সফির ছিল এক মাথা ঢেউ খেলানো চুল। কিন্তু, নতুন চাকরি পাওয়ার পরই সেই চুল কেটে ফেলেছেন তিনি। একেবারে ঘাড় পর্যন্ত ছোট করে চুল কেটেছেন, যে চুলের স্টাইল স্থানীয় স্তরে পরিচিত ‘বয় কাট’ হিসেবে। তবে, শুধু সফি একাই নন, এই ‘বয় কাট’ করাই এখন সৌদি আরবের মহিলাদের নতুন প্রবণতা।
রিয়াধের সালোঁগুলি জানয়েছে, বয়কাটের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিদিন যদি ৩০ জন মহিলা চুল কাটেন, তার মধ্যে ৭ থেকে ৮ জন গ্রাহক ‘বয়কাট’ করাচ্ছেন। বিশেষ করে কিশোরী এবং কুড়ির কোঠায় বয়সী মহিলাদের মধ্যে বয়কাট এখন দারুণ জনপ্রিয়। তবে এই কাট বেশি করান কর্মরত মহিলারাই। সেই দেশের অধিকাংশ চাকুরিজীবী মহিলাই এখন বয় কাট করছেন। কিন্তু কেন? শুধুই কি স্টাইল স্টেটমেন্ট? সৌদি মহিলারা বলছেন না।
অনেকেই মনে করছেন, এই নয়া প্রবণতার অন্যতম কারণ হিজাব সংক্রান্ত নিয়ম বদল। সৌদি শাহজাদা মহম্মদ বিন সালমান, সেই দেশে মহিলাদের হিজাব পরার বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছেন। অনেকেই আগেও বয়কাট করতেন। তবে, হিজাব থাকায় তা দেখা যেত না। তবে, এখন মাথায় হিজাব না থাকায় তাদের চুলের কাট প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে। যা আরও অনেক মহিলাকে এই চুলের স্টাইল অনুসরণ করতে উৎসাহিত করছে। তবে, এটাই সৌদি মহিলাদের বয়কাট করার একমাত্র কারণ নয়।
সৌদি শাহজাদা সালমান, তাঁর দেশের অর্থনীতিকে তেল নির্ভরতা থেকে বের করে আনতে চান। আর এর জন্য তিনি ভিশন ২০৩০ নামে এক প্ররিকল্পনা চালু করেছেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০৩০ সালের মধ্যে, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের নিয়োগ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। তবে, ইতিমধ্যেই সেই লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে গিয়েছে সৌদি আরব। বর্তমানে সেই দেশের মোট শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশ মহিলা। ছোট এবং মাঝারি মানের উদ্যোগের ৪২ শতাংশের মালিক এখন মহিলারা।
আর মহিলারা যত বেশি করে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছেন, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বয়কাট চুলের সংখ্যা। সংবাদ সংস্থা এএফপিকে অনেক কর্মজীবী মহিলাই জানিয়েছেন, বয়কাট চুল তাঁদের পেশাগত চাহিদা। চুল লম্বা রাখলে, তার যত্ন নেওয়ার জন্য অনেক সময় লাগে। কিন্তু, কর্মরত মহিলাদের হাতে অত সময় নেই। এই কারণেই তাঁরা চুল ছোট করে কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শুরুতে যে সফি নামে মহিলা ডাক্তারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর মতো অনেক সৌদি মহিলার কাছে আবার বয়কাট চুল তাঁদের নিরাপত্তার হাতিয়ারও বটে। তিনি জানিয়েছেন, পুরুষরা কোনও মহিলার শরীরে নারীত্ব দেখতে পছন্দ করে। লম্বা বাহারি চুল সেই নারীত্বের পরিচায়ক। যখন তিনি বড় চুল রাখতেন, তখন তাঁকে অনেক পুরুষের অবাঞ্ছিত মনোযোগের মোকাবিলা করতে হত। তবে, তিনি বয়কাট করার পর, এই অযাচিত দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন এবং খোলা মনে রোগী দেখতে পারছেন। সফি বলেছেন, ‘এই স্টাইল আমার কাছে একটা ঢালের মতো, যা আমাকে পুরুষদের হাত থেকে রক্ষা করে এবং আমাকে শক্তি দেয়।’
সৌদি আরবে, এমনিতে পুরুষদের মহিলাদের মতো পোশাক পরা বা মহিলাদের পুরুষদের মতো পোশাক পরা নিষিদ্ধ। তবে, ‘বয়কাট’ চুলের শৈলিপুরুষদের অনুকরণ করা বলে মানছেন না সৌদি মহিলারা। বরং, বয়কাট চুল সৌদি মহিলাদর পুরুষদের থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রতীক বলে মনে করছেন তাঁরা। বয়কাট করা নতুন যুগের সৌদি মহিলাদের দাবি, ‘বয়কাট চুলের স্টাইল আমাদের শক্তি দেয়, আত্মবিশ্বায় জোগায়। এই চুলের স্টাইলে একটা অন্যরকম অনুভুতি হয়। মনে হয়, কারোর অভিভাবকত্ব ছাড়াই আমরা সব করতে পারি।’
অনেকেই জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তাঁদের পরিবার রে রে করে উঠেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। আসলে ইয়াসমিন রইস বা শিরিনের মতো আরব সেলেবরাও এখন বয়কাট চুলের দিকেই ঝুঁকেছেন। সব মিলিয়ে সৌদি আরবে এখন কোনও মহিলা এই স্টাইলে চুল কাটলে, তাঁকে একজন দৃঢ় চরিত্রের মহিলা বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, মহিলাদের পক্ষে তাঁদের লম্বা চুল কেটে ফেলাটা মোটেই সহজ নয়। তাই সৌদি আরবে এখন বয়কাট চুল মানে ‘নারীশক্তির সোচ্চার প্রদর্শন’।