বেজিং: ঠিক যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ৩৩ বছর আগের গণহত্যার স্মৃতি উসকে উঠল। সেদিন বেজিং-এর রাজপথে ছিল গণতন্ত্র-স্বাধীনতাকামী ছাত্রছাত্রীর দল। আর আজ চিনের হেনান প্রদেশের রাজপথে, ব্যাঙ্ক থেকে নিজেদেরই সঞ্চয় তোলার দাবিতে বিক্ষোভকারী নাগরিকরা। সেদিন ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিয়ানানমেন স্কয়ারে যেমন দেখা গিয়েছিল, এখন হেনানেও দেখা যাচ্ছে নিরপরাধ নাগরিকদের বিরুদ্ধে মোতায়েন চিন সৈন্যের সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক। সূত্রের খবর, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই চিনের এই প্রদেশে পুলিশ এবং আমানতকারীদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ চলছে। আমানতকারীদের দাবি, চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে ব্যাঙ্ক থেকে নিজেদেরই সঞ্চিত ধন তুলতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করা যায়নি। তবে ভিডিয়োগুলিতে দেখা যাচ্ছে, আমানতকারীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তায় চিনা পিপলস লিবারেশন আর্মির বেশ কয়েকটি ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হয়েছে। সেগুলির সামনেই আমানতকারীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ট্যাঙ্কগুলিকে টহল দিতেও দেখা গিয়েছে। সেই সঙ্গে সম্ভবত জনতাকে ভয় দেখাতেই ট্যাঙ্ক থেকে ধোঁয়া বা কোনও গ্যাসও ছাড়তে দেখা গিয়েছে।
Tanks deployed on Chinese city Henan’s roads, government declared the money in savings accounts of people as “Investment Instruments”.
Tanks are deployed to “Protect the bank” pic.twitter.com/bLGuspWBHU
— Elite Predators (@elitepredatorss) July 21, 2022
একাধিক মার্কিন এবং হংকং-এর কয়েকটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাঙ্ক অব চায়নার হেনান শাখা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ব্যাঙ্ক থেকে কোনও আমানত তোলা যাবে না। কারণ, তাদের শাখায় আমানতকারীদের সঞ্চয়গুলি হল ‘বিনিয়োগ পণ্য’। ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী, বিনিয়োগযোগ্য পণ্য তোলা যাবে না। এরপরই হেনানের রাজধানী ঝেংঝুতে হিংসাত্মক আকার ধারণ করে আমানতকারীদের বিক্ষোভ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বলেছিল, খেপ খেপে তারা আমানতকারীদের অর্থ তুলতে দেবে। এর প্রথম কিস্তি পাওয়ার কথা ছিল ১৫ জুলাই। তবে, অভিযোগ মুষ্টিমেয় কয়েকজন চাকা পেয়েছেন। বেশিরভাগই কিছু হাতে পাননি। সত্যি সত্যি, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হলে, অন্তত চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস তা ফলাও করে প্রকাশ করত। তারাও এই বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। ফলে অনেকেই সন্দেহ করছেন, ব্যাঙ্কগুলি সম্ভবত দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে।
বস্তুত বেজিং এখন স্থিতিশীলতার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। চিনের একাধিপতি হয়ে ওঠার পর, শি জিনপিংয়ের নিজের স্বার্থেই সব দিক থেকে দেশে স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। কাজেই যদি সামর্থ থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ব্যাঙ্ক-বিক্ষোভের মতো ঘটনাকে বড় হয়ে উঠতে দিতেন না। অনেক আগেই সমাধান করতেন। কাজেই ব্যাঙ্কগুলি ভাঁড়ার সম্ভবত সত্যি-সত্যিই শূন্য। আর এর আভাস দিন কয়েক আগেই চিনা অনলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচারিত বেজিংয়ের এক অধ্যাপকের ভিডিওতেই মিলেছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। ওই অধ্যাপক দাবি করেছিলেন, ২০২২ সালে মুখ থুবরে পড়ছে চিনা অর্থনীতি। বছরের প্রথমার্ধে বহু চিনা সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, শিল্প ও বাণিজ্যিক পরিবারগুলি ব্যবসা থেকে সরে গিয়েছে, বহু সংস্থাগুলি শেয়ার বেচতে বাধ্য হচ্ছে, পাশাপাশি বাড়ছে কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেকারত্ব।
এর পিছনে অন্যতম বড় কারণ হল জমি লিজ দেওয়া নিয়ে দুর্নীতি। যা থেকে স্থানীয় প্রশাসন বড় মাপের রাজস্ব উপার্জন করে থাকে। কিন্তু, বর্তমানে চিনে বহু রিয়েল এস্টেট প্রকল্প অসমাপ্ত পড়ে রয়েছে এবং বহু নির্মাণ সংস্থা জমি না কিনেই প্রকল্প গড়ার কাজ করছেন বলে অভিযোগ। সূত্রের দাবি, প্রায় প্রত্যেক সফল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারই চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কোনও বড় নেতার ঘনিষ্ঠ। আর তা না হলে, সাধারণ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলেই বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারেন। এতে, অর্থনীতির সার্বিক ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাও চিনা কমিউনিস্ট নেতারা না কি এই দুর্নীতির তদন্তে নারাজ। তাঁদের ভয়, তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে যেতে পারে। তাই যেনতেন প্রকারে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা চলছে। ১৯৮৯ সালের ৪ জুনের জঘন্য দিনটা ফের ফিরে আসতেই পারে।