বেজিং: সাল ২০২০। বছরের শুরু থেকেই একের পর এক দেশে ছড়িয়ে পড়ছিল নতুন এক সংক্রমণ। জ্বর, নাকে গন্ধ চলে যাওয়া, মুখে স্বাদ না থাকার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছিল হাজার হাজার মানুষের মধ্যে। আক্রান্তের সংখ্যা হাজার থেকে লক্ষ, সেখান থেকে কোটিতে পৌঁছতে বেশি দিন সময়ও লাগেনি। মার্চ মাসের মধ্যেই গোটা বিশ্ব থমকে যায় করোনা সংক্রমণের (COVID-19) কারণে। বিগত দুই বছর ধরে অক্লান্ত লড়াইয়ের পর বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্বের করোনা সংক্রমণ। তবে করোনার উৎপত্তিস্থল, চিনে (China) আবার ফিরে এসেছে সংক্রমণ। এদিকে, সংক্রমণ রুখতে প্রথম থেকেই মরিয়া ছিল চিনা সরকার। যাতে দেশে একজনও করোনা আক্রান্ত না থাকে, তার জন্য আনা হয়েছিল ‘জিরো কোভিড’ নীতি (Zero COVID Policy)। কঠোর বিধিনিষেধের এই নীতি নিয়েই বর্তমানে বিতর্ক। বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে চিন। বিগত কয়েক দশকের ইতিহাসে এই প্রথম জিনপিং সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে সাধারণ মানুষ।
১. হাতো গোনা কয়েকজন করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিললেই লকডাউন জারি করতে হবে।
২. গণ করোনা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে যে এলাকাগুলিতে করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিলছে, সেখানে গণ পরীক্ষা করাতেই হবে।
৩. যারা করোনা আক্রান্ত, তাদের বাড়িতে নিভৃতবাসে থাকতে হবে বা সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকতে হবে।
৪. যে অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিলছে, সেখানের বাণিজ্যকেন্দ্র ও সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে।
৫. খাবারের দোকান ছাড়া বাকি সমস্ত দোকান বন্ধ রাখতে হবে।
৬. যতক্ষণ অবধি নতুন করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিলবে, ততক্ষণ অবধি লকডাউন জারি থাকবে। তা সে এক সপ্তাহই হোক বা এক মাস।
বর্তমানে চিনের প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ ১ কোটিরও বেশি মানুষ লকডাউনের অধীনে রয়েছেন।
চলতি মাসের শুরু থেকেই হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। বিগত ছয় মাসে এই প্রথম করোনায় কোনও মৃত্যু হয়েছে। চিন প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার চিনে নতুন করে ৪০ হাজারেরও বেশি আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। সবথেকে বেশি আক্রান্তের খোঁজ মিলছে গুয়াংজ়াউ প্রদেশ ও চংকিং প্রদেশ থেকে। বেজিংয়ে দৈনিক ৪ হাজারেরও বেশি আক্রান্তের খোঁজ মিলছে।
নতুন করে সংক্রমণ রুখতে টানা লকডাউন-কোয়ারেন্টাইনের নিয়মে অসন্তোষ বেড়েছে সাধারণ মানুষের মনে। সাধারণ খাবার বা ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবাটুকুও পাওয়া যাচ্ছে না বলেই অভিযোগ বাসিন্দাদের। যারাই করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা যাতে বাড়ি থেকে বের না হতে পারেন, তার জন্য প্রবেশদ্বারে লোহার শিক গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সমস্ত জানালাও। শুধু বাড়িতেই নয়, বিভিন্ন কারখানাতেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। একজন শ্রমিক বা কর্মীর করোনা রিপোর্ট পজেটিভ এলেই সমস্ত কর্মীদের কারখানার ভিতরেই ঘুমাতে বাধ্য করা হচ্ছে। সম্প্রতিই চিনের ফক্সকন কারখানা, যেখানে আইফোন তৈরি হয়, সেখানেও কর্মীরা বিক্ষোভ-ধর্মঘট ডেকেছিলেন কারখানার ভিতরে বন্দি থাকার ভয়ে।
গত সপ্তাহেই চিনের উরুমকিতে একটি আবাসনে আগুন লাগে। কিন্তু সেখানে করোনা আক্রান্ত থাকায় প্রশাসনের তরফে সমস্ত বেরনোর রাস্তা আটকে দেওয়া হয়েছিল। ফলে আবাসনের ভিতরেই আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় কমপক্ষে ১০ জন বাসিন্দার, গুরুতর জখম হন ৯ জন। আগুন লাগার খবর পেয়েও প্রশাসনের তরফে দমকল বাহিনী পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পরই বিক্ষোভে পথে নেমেছেন চিনের বাসিন্দারা।
অন্যদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউন থাকার কারণে খাবারের সমস্য়ার পাশাপাশি ব্যাপক অর্থ সঙ্কটের মুখেও পড়েছেন সাধারণ মানুষ। একাধিক কারখানা বন্ধ থাকায় উপার্জন বন্ধ শ্রমিকদের। যুব প্রজন্ম ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও অভিযোগ। লকডাউনের কারণে বৈদেশিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্যেও প্রভাব পড়ছে। উদাহরণ হিসাবে ফক্সকন কারখানাই দেখা যেতে পারে। সেখানে করোনা সংক্রমণ ও বিক্ষোভের কারণে গোটা বিশ্বেই আইফোনের উৎপাদন ও জোগানে ব্যাপক সঙ্কট দেখা গিয়েছে। আসন্ন খ্রিস্টমাসেও খেলনার সঙ্কট দেখা দিতে পারে ব্যাপক মাত্রায়, কারণ চিনের অধিকাংশ খেলনার কারখানাতেই উৎপাদন বন্ধ।
চিনের অর্থনীতি, যা বিশ্বের অন্যান্য় অর্থনীতিকে ছাপিয়ে দ্রুত এগোচ্ছিল, তার বৃদ্ধির হারও হ্রাস পেয়েছে। গত বছরে যেখানে চিনের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৫ শতাংশ, সেখানেই চলতি বছরে অর্খনীতির বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৯ শতাংশ।
চিনে করোনা সংক্রমণ রুখতে ‘জিরো কোভিড’ নীতি অনুসরণ করলেও, চিনের করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বর্তমানে সেখানে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়। তবে এই ভ্যাকসিন করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট রুখতে ব্যর্থ বলেই দাবি একাংশের।
অন্যদিকে, চিনের অধিকাংশ মানুষই এখনও করোনা টিকা নেননি। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যেই করোনা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। চিনে ৮০ বছর বা তার থেকে বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে কেবল অর্ধেক সংখ্যক মানুষই করোনার প্রথম টিকা পেয়েছেন। ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মাত্র ৬০ শতাংশ করোনা টিকা পেয়েছেন। বিভিন্ন পশ্চিমী দেশের তরফে ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করার আশ্বাস দেওয়া হলেও, সেই সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছে চিন।