ঘুরতে ঘুরতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবী। কিন্তু এত দিনের অভ্যাস তো! তাও ঘুরে যাচ্ছে। তবে জানেন, পৃথিবীর ভিতর আরও একটি ‘পৃথিবী’ আছে। সে কিন্তু আর ঘুরতে চাইছে না। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বলছে, এবার আমি একটু ধীরে ঘুরব। প্রয়োজনে উল্টো ঘুরব। আর তাতেই বিপদে পড়েছে আমাদের ধরিত্রী। হ্যাঁ, সম্প্রতি ‘নেচারে’ প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে হইচই পড়েছে বিজ্ঞান পাড়ায়। তাঁরা নাকি পৃথিবীকে নিয়ে বেশ চিন্তিত।
পৃথিবীর ভূগর্ভকে ভাগ করলে, প্রথম ভূত্বক যাকে ম্যান্টল বলা হয়। প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার পুরু। তারপর লিকুইড আউটার কোর থাকে, যেটি প্রধানত লোহা এবং নিকেল ধাতুর তরল স্তর। ২২৬০ কিলোমিটার পুরু। ইনার কোর এবং ভূত্বকের মাঝামাঝি যার অবস্থান। আর শেষে হল ইনার কোর। যেটি একদম কঠিন গোলাকার বস্তু। এই স্তরকেই আর একটি ‘পৃথিবী’ বলা যেতে পারে। ১২২০ কিলোমিটার ব্যস এবং পৃথিবীর ২০ শতাংশ জায়গা জুড়ে যার অবস্থান। যত কাণ্ড এই ইনার কোরকে নিয়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ইনার কোরই এখন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
কী সেই বিদ্রোহ? তার আগে একবার বুঝে নিই, এই ইনার-কোরের কাজ কী? ইনার কোর নিয়ে বিজ্ঞানীদের হাতে তেমন কোনও তথ্য নেই। অধিকাংশই অনুমান ভিত্তিক। কারণ, এই ইনার কোর এত ভিতরে অবস্থান, পৃথিবীকে ফুটো করেও অতদূর পর্যন্ত পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। আমাদের যতটা দৌড় মহাকাশে, ততটাই পৃথিবীর ভূগর্ভে। তাই এই বিষয়ে বেশিরভাগটাই সাদা পাতা। তবে, ভূতরঙ্গ এবং ভূচৌম্বকের উপর নির্ভর করে এই ইনার কোর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। মনে করা হয়, লিকুইড আউটারের মতোই ইনার কোর লোহা আকরিক-নিকেল সহ অন্যান্য ধাতু দিয়ে তৈরি, তবে কঠিন জাতীয়। এর তাপমাত্রা প্রায় ৫৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের উপরিতলের তাপমাত্রার কাছাকাছি। বুঝতে পারছেন, পৃথিবীর বুকের ভিতর কতটা আগুন জ্বলছে।
এই ইনার কোর কিন্তু পৃথিবীর মতোই বনবন ঘোরে। আপনি বলবেন, পৃথিবী যদি ঘোরে তো সবাই ঘুরবে, এতে নতুন কী আছে। না, পৃথিবীর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে ঘোরার দিব্যি ইনার কোরের নেই। যে নিজের ইচ্ছে মতো ঘোরে। ১৯৩৬ সালে ডেনমার্কের ভূবিজ্ঞানী ইঞ্জে লেহমান ইনার কোরের ঘোরা নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেন। এরপর প্রচুর গবেষণা হয়। ইনার কোরের ঘোরা নিয়ে নানা মুণির নানা মত রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌতবিজ্ঞানী এবং প্রফেসর লরেন ওয়াজেক বলেন, ইনার কোর সম্পর্কে এতই কম তথ্য রয়েছে, তাই কোনও কিছু সিদ্ধান্তে আসা বড় কঠিন। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ সাল থেকে ইনার কোর সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানা যায়। এখনও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন ইনার কোর নিয়ে।
কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন, এই ইনার কোর একটা সময় পৃথিবীর থেকেও দ্রুত ঘুরেছে। এখন অনেকটাই ধীরে ঘুরছে। একটা সময় পৃথিবী এবং ইনারকোরের ঘূর্ণন সমান-সমান ছিল। গত ১২ জুন নেচার পত্রিকায় ইনার কোরের এই মন্থর গতিতে সিলমোহর দেয়। ২০২৩ সালে এই বিষয়ে যে গবেষণা পত্র জমা পড়ে, তাতে অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, এই ইনার কোর ৭০ বছর অন্তর অন্তর গতি পরিবর্তন করে। তবে, এটাও বিজ্ঞানীরা মেনে নিচ্ছেন, মাত্র ২০ বছরের তথ্য নিয়ে এই সিদ্ধান্তে এখনও উপনীত হওয়া যায় না, কিন্তু লক্ষণ মোটেই ভাল নয়। ইনার কোর যদি মন্থর গতি কিংবা উল্টো ঘুরতে শুরু করে অবশ্য পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে প্রভাব পড়তে পারে। দিন আরও ছোট হয়ে যেতে পারে।
সত্যিই কি এমন হবে? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, গবেষণা আরও প্রয়োজন। তবে, সিঁদুরের মেঘ যে জমছে, একথাও অস্বীকার করছেন না তাঁরা। এবার যদি দুরন্ত ঘূর্ণির পাক কম পড়ে, ছন্দে ছন্দে আর কি রং বদলাবে পৃথিবীর, সেটাই এখন দেখার।