EXPLAINED: আল কায়েদার জিহাদি থেকে সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের ‘নায়ক’, সিনেমার থেকে কম নয় গোলানির যাত্রা

EXPLAINED: আমেরিকা একসময় তাঁর মাথার দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৭৫ কোটি টাকা ধার্য করেছিল। ISIS নেতা আবু বকর আল বাগদাদির মৃত্যুর পর সিরিয়ার ইদলিব সংলগ্ন এলাকায় সমান্তরাল সরকার চালাতে থাকেন আবু মহম্মদ আল গোলানি। কীভাবে আল কায়েদা জিহাদি থেকে হয়ে উঠলেন সিরিয়ার অভ্যুত্থানের নায়ক? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...

EXPLAINED: আল কায়েদার জিহাদি থেকে সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের 'নায়ক', সিনেমার থেকে কম নয় গোলানির যাত্রা
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 11, 2024 | 11:52 PM

টিকালো নাক। চওড়া কাঁধ। স্থির দৃষ্টি। সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের নায়ক তিনি। আবু মহম্মদ আল গোলানি। বছর বিয়াল্লিশের এই যুবকই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কী তাঁর পরিচয়? সিরিয়ায় সশস্ত্র বিদ্রোহে তাঁর ভূমিকা কী? একসময় আল কায়েদার হয়ে কাজ করা গোলানি কীভাবে হয়ে উঠলেন সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহীদের নেতা? কীভাবে হল সিরিয়ার এই অভ্যুত্থান, যার জেরে ২৪ বছরের শাসক বাশার আল-আসাদকে দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে হল?

আল কায়েদার জিহাদি থেকে এইচটিএসের নেতা-

হঠাৎ করে নেতা হয়ে ওঠেননি গোলানি। একসময় ইরাকে আল কায়েদার জিহাদি ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আগে তাঁর সংগঠনের নাম ছিল জাবহত ফাতেহ আল-শাম। সংগঠনের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। নাম রাখেন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)।

আমেরিকা একসময় তাঁর মাথার দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৭৫ কোটি টাকা ধার্য করেছিল। ISIS নেতা আবু বকর আল বাগদাদির মৃত্যুর পর সিরিয়ার ইদলিব সংলগ্ন এলাকায় সমান্তরাল সরকার চালাতে থাকেন গোলানি। বাশার-বিরোধী এমন একজন শক্তিশালী নেতাকে আমেরিকা তলায় তলায় সাহায্য করতে শুরু করে বলে জানা গিয়েছে।

আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করায় বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে গোলানির এইচটিএসের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। ভাবমূর্তি বদল হয় গোলানির। জিহাদি থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন সিরিয়ার জনপ্রিয় মুখ। তাঁর সংগঠন সিরিয়ার এই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হায়াত তাহরির আল শামের পাশাপাশি জইশ আল-ইজ্জাও সিরিয়ার এই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এই দুই গোষ্ঠীর সঙ্গে অতীতে আইসিস ও আল কায়েদার যোগাযোগ ছিল।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে গোলানি বলেছিলেন, “সিরিয়ায় একটা সিস্টেম প্রয়োজন। যেখানে প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত নেবে, কোনও এক নেতা নন।” বাশার আল-আসাদের শাসনের পতন হলে নিজের সংগঠন ভেঙে দেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন তিনি।

আহমেদ আল-শারাকে চেনেন?

প্রশ্ন শুনে মনে আসবে, গোলানির কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ আল-শারার কথা কেন? কে এই আল-শারা? আসলে দু’জনে একই ব্যক্তি। একসময় আল-শারা থেকে গোলানি হয়ে উঠেছিলেন। আবার সেখান থেকে আল-শারা হয়ে ওঠা। বাশার আল-আসাদ দেশ ছাড়ার পর প্রকৃত নামেই নিজেকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন গোলানি। জানান, তাঁর প্রকৃত নাম আহমেদ আল-শারা। আল কায়েদার হাত ধরে গোলানি হয়ে উঠেছিলেন। এখন আবার আহমেদ আল-শারা হলেন। তবে এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না।

২০১৪ সালে প্রথম সাক্ষাৎকার-

২০১৪ সালে প্রথমবার আল জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন গোলানি। তখন সেটাই তাঁর পরিচয়। তবে প্রথম সাক্ষাৎকারে তাঁর মুখ ঢাকা ছিল। সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে জেনেভায় রাজনৈতিক আলোচনা তাঁরা খারিজ করছেন বলে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সিরিয়ায় ইসলামি আইনের শাসন দেখতে চান। সেখানে সংখ্যালঘুদের কোনও স্থান হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।

২০১৬ সালে প্রথমবার তাঁকে মুখ না ঢাকা অবস্থায় দেখা যায়। এক ভিডিয়ো বার্তায় তিনি বলেছিলেন, আল কায়েদার সঙ্গে তিনি সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এবং তাঁর সংগঠনের নাম পরিবর্তনের কথাও ঘোষণা করেন। সেখান থেকেই বদল শুরু গোলানির।

২০২১ সালে প্রথমবার কোনও মার্কিন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। পরনে ছিল ব্লেজার। অনেক শান্ত। জানিয়েছিলেন, তাঁরা পশ্চিমের জন্য ভীতিপ্রদ নয়। বলেছিলেন, “আমরা পশ্চিমী নীতির অবশ্যই বিরোধিতা করি। কিন্তু, সিরিয়া থেকে আমেরিকা কিংবা ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আশঙ্কা নেই। আমরা কখনও বলিনি, আমরা যুদ্ধ করতে চাই।”

বাশার আল-আসাদের পতন-

বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেছেন। ২০০০ সালের ১০ জুন তাঁর মৃত্যু হয়। হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর সময় বাশারের বয়স ছিল মাত্র ৩৪। সেই বয়সেই সিরিয়ার শাসক হন তিনি। যদিও প্রথমদিকে রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। ডাক্তারি পড়তেন লন্ডনে। সেখানকার কিংস কলেজের লিটারেচারের ছাত্রী আসমার সঙ্গে তখন চুটিয়ে প্রেম করছেন। পরে তাঁকেই বিয়ে করেন।

বাশার সিরিয়ার শাসক হওয়ার পর প্রথমদিকে তাঁকে নিয়ে খুশি ছিলেন সিরিয়াবাসী। গদিতে বসার পর সরকারি ব্যবস্থায় স্বজনপোষণ বন্ধ করেন বাশার। আর্থিক সংস্কার করেন। একাধিক পদক্ষেপে সাধারণ নাগরিকদের মন জয় করে নেন। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন বাশার। একসময় সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে খুন হওয়া রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাসারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আর সেই ক্ষোভ থেকেই ২০১২ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সিরিয়ায়। মৃত্যু হয় ৫ লক্ষের বেশি মানুষের। ঘরছাড়া হন বহু মানুষ।

২০১৩ সালে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে বাসার প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সিরিয়ার কুখ্যাত সৈদনায়ার জেলে নৃশংস অত্যাচার করে খুন করা হত বিদ্রোহীদের। এই সৈদনায়ার জেল ছিল বাসারের গুমঘর। অ্যামনেস্টি ইন্ট্যারন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে, জেলের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার বন্দিকে অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে।

সেই ক্ষোভ জমতে জমতে এখন ‘বিস্ফোরক’ হয়ে উঠল। আর সেই বিস্ফোরণেই মাত্র ১২ দিনে আসাদের শাসনের অবসান ঘটেছে। দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে হয়েছে আসাদকে। আর তাঁর এই পতনে মহীরূহ হয়ে দেখা দিয়েছে গোলানি। থুড়ি আহমেদ আল-শারা। এখন সিরিয়ায় যে এই নামেই ছড়িয়ে পড়ছেন তিনি। গোলানিকে অতীত করে শারা হয়ে উঠেছে বছর বিয়াল্লিশের যুবক। যার স্থির দৃষ্টি ২৪ বছরের শাসককে দেশ ছাড়া করেছে।