EXPLAINED: ভারতের চালেই বাজিমাত, কোন পথে ব্রিটেনের কাছ থেকে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ আসছে মরিশাসের হাতে?

Chagos Islands: মরিশাস কার্যত ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের নিয়ে তৈরি। ব্রিটিশরা ভারতীয়দের বাগিচা শ্রমিক হিসাবে মরিশাসে নিয়ে যেত। তাঁদের সন্তান-সন্ততিরাই আজ ওই দেশের নাগরিক। মরিশাসের প্রাক্তন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পূর্বপুরুষরাও ভারত থেকেই ওদেশে গিয়েছিলেন। ফলে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের হাতে যাতে ব্রিটেন তুলে দেয়, তার জন্য বড় ভূমিকা পালন করে নয়াদিল্লি। কোন পথে মরিশাসের হাতে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ তুলে দিতে রাজি হল ব্রিটেন? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...

EXPLAINED: ভারতের চালেই বাজিমাত, কোন পথে ব্রিটেনের কাছ থেকে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ আসছে মরিশাসের হাতে?
কীভাবে বাজিমাত করল ভারত?
Follow Us:
| Updated on: Jan 04, 2025 | 10:59 PM

উপমহাদেশ থেকে তো সেই কবেই ব্রিটিশরা পাততাড়ি গুটিয়েছে। তবে, ভারত মহাসাগরে তাদের বেআইনি জবরদখল যায়নি। অবশেষে তাও শেষ হতে চলেছে। মুছে যাওয়ার পথে আফ্রিকার শেষ ব্রিটিশ কলোনি। কয়েকটা জায়গায় কিছু জটিলতা আছে। তবে মোদ্দা কথা, চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছে ব্রিটেন। কেন এই সিদ্ধান্ত নিল তারা? ব্রিটেনের সুর নরমের পিছনে ভারতের ভূমিকা কী?

গোড়ায় ইতিহাসটা একটু বলা দরকার। মরিশাস ছিল ব্রিটিশ কলোনি। ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশরা মরিশাস ছেড়ে চলে যায়। যদিও, মরিশাসের কাছে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের অধিকার তারা ছাড়েনি। এই অঞ্চলটাকে তাই বলা হত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশেন টেরিটরি। ১৯৭০ সালে ব্রিটিশরা আরও একটা ‘খারাপ’ কাজ করে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সবথেকে বড় দ্বীপের নাম দিয়াগো গার্সিয়া। সেখানে সেনাঘাঁটি তৈরির জন্য দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২ হাজার মানুষকে উত্‍খাত করে তারা সেসেলশ ও মেনল্যান্ড মরিশাসে পাঠিয়ে দেয়। এই নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় উঠলেও ব্রিটেন তাতে পাত্তা দেয়নি। বরং নিজেদের হাত শক্ত করতে তারা দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপ নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলে। সেখানে দুই দেশের যৌথ সেনাঘাঁটি তৈরি হয়ে যায়। মার্কিন স্বার্থ জড়িয়ে যাওয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায়।

তবে মরিশাস ছেড়ে দেয়নি। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে আন্তর্জাতিক আদালত, সব দরজায় কড়া নাড়ে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা, আন্তর্জাতিক আদালত, ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি- এই তিন প্রতিষ্ঠান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রায় দেয় যে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের উপর মরিশাসেরই অধিকার। ব্রিটেন এই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে মরিশাসের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। এরপর ২০২২ সাল থেকে মরিশাস সরকারের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের ১৩ দফা আলোচনা হয়। অবশেষে, নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টার্মার জানান যে তাঁরা চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের হাতে তুলে দিচ্ছেন। মানে এটা পরিষ্কার যে ব্রিটেন নেহাতই সহৃদয় হয়ে এই কাজ করছে না। বরং প্রবল চাপের মুখে তারা চাগোস দ্বীপপুঞ্জ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

নতুন প্রস্তাব ব্রিটেন-আমেরিকার-

চাগোস দ্বীপপুঞ্জ ছাড়ার কথা বললেও সমস্যা হয় ব্রিটেনের একটি প্রস্তাবে। কী সেই প্রস্তাব? ব্রিটেন-আমেরিকা মরিশাসকে জানায়, চাগোস তারা ছেড়ে দিলেও দিয়াগো গার্সিয়ায় তারা সেনাঘাঁটি রেখে দিতে চায়। এজন্য দুই দেশ মরিশাসকে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি। এসব নিয়ে মরিশাসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রভিন্দ জগন্নাথের সঙ্গে ব্রিটেন-আমেরিকার কথা চলছিল।

মরিশাসে পালাবদল-

এরই মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে মরিশাসে নির্বাচন হয়। আর সেই ভোটে জগন্নাথ হেরে যান। মরিশাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নবীনচন্দ্র রামগুলাম। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে টাকার অঙ্ক না বাড়ালে তিনি দিয়াগো গার্সিয়ায় বিদেশি নৌ-ঘাঁটি থাকতে দেবেন না। বিষয়টা নিয়ে এখন তিন দেশের দর কষাকষি চলছে।

মরিশাসের সঙ্গে ভারতের যোগ-

মরিশাস দেশটাই কার্যত ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের নিয়ে তৈরি। ব্রিটিশরা ভারতীয়দের বাগিচা শ্রমিক হিসাবে মরিশাসে নিয়ে যেত। তাঁদের সন্তান-সন্ততিরাই আজ দেশটার নাগরিক। মরিশাসের প্রাক্তন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পূর্বপুরুষরাও ভারত থেকেই ওদেশে গিয়েছিলেন। চাগোস দ্বীপপুঞ্জের অধিকার মরিশাস ফিরে চলায়, স্বাগত জানিয়েছে ভারত। বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়, ডি-কলোনাইজেশনের লক্ষ্যে এটা একটা ভাল পদক্ষেপ। দিল্লি আগের মতোই পোর্ট লুইসের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখবে।

চাগোস নিয়ে ব্রিটেনের সুর নরমের কারণ-

এতদিন চাগোস দখলে রাখার পর হঠাৎ ব্রিটেন নরম হল কেন? এর পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ভারতের। কৌশলগত ভাবে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক মাসে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে গিয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশে পালাবদল ও সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে আমেরিকার নজর। দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগর নিয়ে চিনের বহুমুখী কৌশল। তৃতীয়ত, চিন সাগরের ৯০ শতাংশ এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চাপ বাড়ানো। এসব ঘটনা একে, অন্যের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে। আর তাই চাগোস নিয়ে উদ্যোগী হয় ভারত। সূত্রের খবর, ব্রিটেনকে বলা হয় যে চাগোসকে মরিশাসের হাতে তুলে দিলে দিয়াগো গার্সিয়া নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতা করতে মরিশাস তৈরি। সমঝোতার এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। সঙ্গে ভারতের তরফে আরও কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরা হয়। ব্রিটিশদের বলা হয়, আপনাদের পক্ষে এত দূর থেকে চাগোসের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন। তা ছাড়া মরিশাসের মানুষ তাঁদের দ্বীপ ফেরত চাইছেন। এটা ব্রিটিশ সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে খারাপ। এই দ্বীপ মরিশাসের হাতে তুলে দিলে তাতে ব্রিটেনের কোনও ক্ষতি নেই। এসবের প্রেক্ষিতেই চাগোস দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে দুই দেশের সমঝোতা।

পাশে থাকার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মরিশাস সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মলদ্বীপ থেকে সেনা ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার পর বিকল্প হিসাবে মরিশাসকে পাখির চোখ করেছে ভারত। মরিশাসে রীতিমতো কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে দিল্লি। দুই দেশই এনিয়ে প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও দেওয়াল লিখনটা বোঝাই যাচ্ছে। মরিশাস নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পথেই হাঁটছে ভারত।