হোয়াইট হাউসে দিওয়ালি পার্টি হোক বা হিন্দু মন্দিরে ডেমোক্রাটদের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর পুজো, ভোটটা যে ভারতে নয়, আমেরিকায় হয়েছে, তা বোঝা দায় প্রচারের বহর দেখলে। লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে যেমন নেতারা জনসভা করেন, মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন, সেই দৃশ্যই এবার দেখা গিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। বরং বলা চলে, এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্পটলাইটে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান ভোটাররাই। তবে কি আমেরিকায় রাজত্ব করছে ভারতীয়রাই?
বিশ্বের সবথেকে বড় অর্থনীতির দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঝড় তুলে ফের একবার ক্ষমতায় ফিরছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদে বসবেন। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে একাধিক রেকর্ড গড়েছেন ট্রাম্প। এর মধ্যে অন্যতম হল সর্বাধিক পপুলারিটি ভোট। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার নিরিখে সবথেকে বেশি ভোট পেয়ে রেকর্ড গড়েছেন ট্রাম্প। চমকপ্রদ তথ্য হল, এই ভোটের একটা বড় অংশই পেয়েছেন ইন্দো-আমেরিকান বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান ও অনাবাসী ভারতীয়দের থেকে।
প্রচারের সময় থেকেই ডেমোক্রাট ও রিপাবলিকান- দুই দলই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল অনাবাসী ভারতীয়দের। অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভেনিয়া ও উইসকনসিনের মতো সুইং স্টেট, যে প্রদেশগুলি নির্বাচনের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে, সেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম কমলা হ্যারিসের। তবে শেষ হাসি হেসেছেন ট্রাম্পই। এই সুইং স্টেটের অধিকাংশ জায়গাতেই ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করেছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানরাই। অতীতে ডেমোক্রাটদেরই সমর্থন জানাতে দেখা গেলেও, হঠাৎ ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মন বদল হল। কেন?
তথ্য় অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রায় ৫.২ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫২ লক্ষ ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত থাকেন। এর মধ্যে ৩.৯ মিলিয়ন বা ৩৯ লক্ষই প্রাপ্তবয়স্ক। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে প্রায় ২৬ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূতই মার্কিন ভোটার। আমেরিকার মোট ভোটার সংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যাটি খুব কম হলেও, এবারের নির্বাচনে অন্যতম নির্ণায়ক ছিলেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাই।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক দেশ আমেরিকায় ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে দ্রুত উন্নতি হয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের বার্ষিক আয় আনুমানিক ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ডলারের কাছাকাছি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার গড় আয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
অন্যতম আরও একটি কারণ হল, আমেরিকায় দ্রুত ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের বড় প্রতিষ্ঠান, তা তথ্য প্রযুক্তিই হোক বা ই-কমার্স, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসকদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভারতীয়। তাদের ভোট পেতেই এত জারিজুরি মার্কিন রাজনীতিবিদদের।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবার হোয়াইট হাউসে সবথেকে বড় দিওয়ালি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। প্রায় ৬০০ প্রভাবশালী ভারতীয়-আমেরিকানরা এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। মিনেসোটা গভর্নর টিম ওয়াজ়, যিনি কমলা হ্যারিসের রানিং মেট অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন, তিনিও পেনসিলভেনিয়ায় একটি হিন্দু মন্দিরে গিয়েছিলেন দিওয়ালি উদযাপন করতে।
পিছিয়ে থাকেননি রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পও। বরং তিনিই মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছেন। দিওয়ালির শুভেচ্ছাবার্তাতেই বাংলাদেশে হিন্দুদের উপরে হামলার নিন্দা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ক্ষমতায় থাকলে, এমন ঘটনা ঘটতে দিতেন না. এ কথাও বলেন। ট্রাম্পের এই মন্তব্য হিন্দু আমেরিকান ভোটারদের ব্যাপক প্রভাবিত করেছে বলেই মত বিশ্লেষকদের। তার ফল দেখা গিয়েছে পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, মিশিগানের ভোটেও।
এর আগেরবার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন টেক্সাসে ‘হাউডি মোদী’র আয়োজন করেছিলেন ট্রাম্প। ভারতেও ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। তবে এবার কিন্তু কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প-কারোর সপক্ষেই প্রচার করেননি মোদী। কমলা হ্যারিসের ভারতীয় যোগ রয়েছে, তামিলনাড়ুর গ্রামেই শিকড় তাঁর। নির্বাচনের সময় কমলার সমর্থনে সেই গ্রামে পোস্টার পড়লেও, রাজনৈতিক নেতারা রা কাটেননি কারোর সপক্ষেই।
রাজনীতি, কূটনীতির গণ্ডি পেরিয়েও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছিলেন ট্রাম্পই। নির্বাচনের আগে সমীক্ষায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানরা বলেছিলেন, তাদের মতে ট্রাম্পের প্রশাসন ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের জন্য লাভজনক হবে। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী ভারতীয়রা ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি নিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত। তবে নতুন প্রজন্ম, যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমেরিকাতেই, তাদের মতে পরিবর্তিত বিশ্বে ট্রাম্পের মতো একজন প্রভাবশালী নেতারই প্রয়োজন, যিনি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
আমেরিকার দেশি ভোটারদের অন্যতম শঙ্কা মুদ্রাস্ফীতি। নতুন প্রজন্মের ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের একটা বড় অংশই মনে করেছিল যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে, তিনি মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা আরও ভালভাবে সামাল দিতে পারবেন।
এছাড়া আমেরিকায় চাকরির সঙ্কট থেকে শুরু করে গর্ভপাত বিরোধী আইনের মতো জ্বলন্ত ইস্যুও রয়েছে। এক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসের প্রশাসন তুলনামূলকভাবে নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। আর এই সুযোগেই বাজিমাত করেছেন ট্রাম্প।
এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন। তবে অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা কিন্তু ডেমোক্রাটদেরই সমর্থন করতেন। তবে পরবর্তী প্রজন্মকে ধীরে ধীরে রিপাবলিকানদের প্রতিই ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। এর প্রমাণ মিলেছে এবারের নির্বাচনেও। ট্রাম্প প্রশাসনে হাউস অব সেনেটে ছয়জন ভারতীয় আমেরিকান স্থান পেয়েছেন। সিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবেও ট্রাম্প সম্ভবত ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাশ্যপ পটেলকেই বেছে নিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।