নয়া দিল্লি: ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছিল আগে থেকেই। শেষমেশ বেধেই গেল যুদ্ধ। আর রাখঢাক নয়, এবার সম্মুখ সমরে ইজরায়েল-ইরান। একদিকে যেখানে পেজার, ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণে কাঁপছে লেবানন, এয়ার স্ট্রাইকে হিজবুল্লা প্রধানকে খতম করা হয়েছে, সেখানেই ২০০ ব্যালেস্টিক মিসাইল দিয়ে আঘাত হেনে পাল্টা জবাব দিয়েছে ইরান। এই যুদ্ধ যে ভয়ঙ্কর আকার নিতে চলেছে, তা আন্দাজ করতে পারছে বিশ্বের সমস্ত শক্তিধর দেশই। আমেরিকা ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমে পড়েছে, যুদ্ধে ইজরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে চোখ রাঙিয়েছে ইরানকে। এই পরিস্থিতিতেই চিন্তায় ভারত। যুদ্ধের ময়দানে না থেকেও ক্ষতির আশঙ্কায় ঘুম উড়েছে অনেকের। এক ঝটকায় তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কেন?
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ-র তথ্য অনুযায়ী, ইজরায়েল, লেবানন, ইরান, জর্ডানের মতো দেশে যুদ্ধ ভারতের বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এর কারণ এই দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য করে ভারত। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনেরও দাবি, ইজরায়েল ও ইরানের মধ্য়ে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হলে ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করবে। এর অন্যতম কারণ হল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল ব্যবসায়ী দেশ হল ইরান। যুদ্ধে আবহে যদি তেল উত্তোলন প্রভাবিত হয়, তবে যেমন বিশ্বজুড়েই তেলের দাম বাড়বে, তেমনই আবার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তেল আমদানি করতেও খরচ বাড়বে অনেকটাই। বিশেষ করে যে দেশগুলি তেল আমদানি নির্ভর, সেই দেশগুলিতে চড়চড়িয়ে বাড়বে তেলের দাম। ইতিমধ্যেই ব্যারেল প্রতি চার ডলার করে দাম বেড়েছে তেলের।
পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ বাধার আগেই রসদ ব্যয় অনেক বেড়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কাঁচামালের দাম আরও বাড়লে অপরিশোধিত তেল, ইলেকট্রনিক্স এবং কৃষি খাতের ব্যবসায় ক্ষতি হতে পারে। রফতানিকারকদের মতে, যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত দেশগুলিতে এবার পণ্য রফতানির জন্য বিমা ব্যয়ও বাড়তে পারে। এর প্রভাব অবশ্যই ভারতীয় বাণিজ্যে পড়বে।
আমদানির ক্ষেত্রে আরও চিন্তা বাড়াচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালীও। ইরান-ইজরায়েলের যুদ্ধের জেরে যদি ইরান হরমুজ প্রণালী আটকে দেয়, তাহলে বিশ্বে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে চরম সমস্যায় পড়বে ভারতের মতো তেল আমদানিকারী দেশগুলি। তেলের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ তো বাড়বেই, তার উপরে মূল্যবৃদ্ধি আবারও মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা।
ওমান ও ইরানের মধ্যে সরু সমুদ্র পথ বা প্রণালী হল হরমুজ। কম বেশি ৪০ কিমি চওড়া এই প্রণালীর পথ। সরু পথে দুটি জাহাজের মধ্যে মাত্র ২ কিলোমিটারের ফাঁক থাকে। তবে এই জলপথ দিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ তেল আমদানি-রফতানি হয়। বিশ্বের তেল রফতানির আমদানি-রফতানির প্রায় ২০ শতাংশ হয় হরমুজ প্রণালী দিয়েই। তাই ইরান এই পথ বন্ধ করলে সমস্যায় পড়তে হবে গোটা বিশ্বকে।
ভারতে তেলের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশই আমদানি করা হয় বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকে। মূলত সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী থেকে তেল আমদানি করা হয়। কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে দেশীয় তেল উৎপাদক সংস্থাগুলি। এবার এই তেল দেশে এসে পৌঁছয় হরমুজ প্রণালীর পথ ধরেই।
ভারত বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক। যুদ্ধের কারণে যদি অপরিশোধিত তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, তবে স্বাভাবিকভাবেই দেশে পেট্রোল-ডিজেল থেকে শুরু করে রান্নার গ্যাসের দাম হু হু করে বাড়তে পারে।
তবে কিছুটা স্বস্তির কথা হল, ইজরায়েল ও ইরান- দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। একদিকে যেখানে তেলের জন্য ইরানের মুখাপেক্ষী ভারত, সেখানেই আবার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অন্যতম ভরসা ইজরায়েল। দীর্ঘদিন ধরেই ইজরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র সামগ্রী থেকে প্রতিরক্ষা বিষয়ক নানা জিনিস কিনছে ভারত। বিশ্বের সেরা প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অস্ত্র-শস্ত্র ইজরায়েলের হাতেই রয়েছে। অন্যদিকে, সম্প্রতি চাবাহারের বন্দরের কাজ এগোনোর পর ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও সহজ হয়েছে। এই বন্দর তৈরি হয়ে গেলে, পাকিস্তানকে এড়িয়েই আফগানিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছনো যাবে। এতে জলপথে বাণিজ্যে আরও সুবিধা হবে।
ভারত মূলত পশ্চিম এশিয়ায় বাসমতি চাল, সুতো, সুতির কাপড়, বহুমূল্য রত্ন ও গহনা রফতানি করে। আমদানি করে পেট্রোলিয়াম পণ্য, হিরে, উন্নত প্রযুক্তির পণ্য, চিকিৎসা সামগ্রী। এশিয়ার মধ্যে ভারতই ইজরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকেই শুরু হওয়া যুদ্ধের জেরে বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। চলতি আর্থিক বছরে এপ্রিল-জুলাই মাসে ইজরায়েলে ভারতের রফতানির অঙ্ক ৬৩৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষেই এই অঙ্কটা ছিল ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবর্ষের প্রথম চার মাসে ইজরায়েল থেকে ৪৬৯.৪৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। গত অর্থবর্ষে এর অঙ্ক ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
অন্যদিকে, চলতি অর্থবর্ষের এপ্রিল-জুলাই মাসে ইরানে ভারত ৫৩ কোটি ৮৫.৭ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। গত অর্থবর্ষে এর অঙ্ক ছিল ১.২২ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ইরান থেকে ১৪ কোটি ৬ লাখ ৯ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে, যা গত বছরে ছিল ৬২ কোটি ডলারেরও বেশি।
এই অঙ্ক দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুই দেশের পরোক্ষ যুদ্ধেই ভারতের বাণিজ্য কতটা প্রভাবিত হচ্ছিল। এবার তো সরাসরি যুদ্ধ। আমদানি-রফতানিতে আরও প্রভাব পড়বে বলেই আশঙ্কা কূটনীতিকদের।