মস্কো: রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে গিয়েছে দুটি প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন – নর্ড স্ট্রীম ১ এবং ২। দুটি পাইপলাইনেই আকস্মিক গ্যাস লিক শনাক্ত করার পর থেকে জোর চর্চা চলছে এই বিষয় নিয়ে। দাবি করা হচ্ছে এটাই বিশ্বের ইতিহাসে সবথেকে বড় গ্যাস লিকের ঘটনা। যার জেরে সমুদ্রের উপর প্রায় এক কিলোমিটার ব্যাস এলাকা জুড়ে মিথেন গ্যাসের বুদবুদ উঠছে। একদিকে, রাশিয়া অভিযোগ করছে এর পিছনে রয়েছে নাশকতা। অন্যদিকে, ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ দাবি করছে এর পিছনে মস্কোরই হাত রয়েছে। এই দুটি গ্যাসের পাইপলাইন কেন ফুটো হল, এতে কীই বা ক্ষতি হবে? আসুন জেনে নেওয়া যাক সবকিছু –
ঠিক কী ঘটেছে?
গত সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইনের অপারেটর, পাইপ লাইনে রাতারাতি হঠাৎ চাপ কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। এরপর ডেনমার্কের শক্তি কর্তৃপক্ষের জানিয়েছিল, সম্ভবত ড্যানিশ জলসীমার আওতায় থাকা দুটি নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের একটিতে ফাটল ধরেছে। সেখান তেকে গ্যাস লিক করছে। এর কয়েক ঘন্টা পরই, নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের আরেক অপারেটর সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস পাইপলাইনে চাপ কমার কথা জানিয়েছিল। মঙ্গলবার সুইডেনের মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও নর্ড স্ট্রিম ১-এ দুটি জায়গায় গ্যাস লিকের বিষয়ে সতর্ক করে। সব মিলিয়ে ডেনমার্ক এবং সুইডেনের সরকারের দাবি অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে বাল্টিক সাগরের নিচে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনে “কয়েকশো কিলো বিস্ফোরকের অনুরূপ বিস্ফোরণ ঘটেছে সমুদ্রের নিচে”। বিস্ফোরণের ফলে যে কম্পন তৈরি হয়, রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ২.৩ এবং ২.১। এর ফলে মোট চারটি জায়গায় পাইপে ফাটল ধরেছে। দুটি ডেনমার্তের জলসীমায়, অন্য দুটি সুইডিশ জলসীমায়।
কী কারণে এই লিক হল?
কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই ধরনের পাইপ ফুটো হয়ে যাওয়া বিরল শুধু নয় অভূতপূর্ব ঘটনা।
সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রযুক্তিগত ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, এমনকি সম্ভাব্য নাশকতার কথা উঠে এসেছে। সুইডিশ ন্যাশনাল সিসমিক নেটওয়ার্ক গ্যাস লিক হওয়ার কিছু আগে ওই এলাকার কাছাকাছি দুটি “ব্যাপক শক্তির প্রকাশ” রেকর্ড করেছে। এরপরই ইউক্রেন-সহ একাধিক দেশ দাবি করেছে, পাইপে ফুটো হওয়া সম্ভবত মস্কো পরিচালিত “সন্ত্রাসবাদী হামলার” ফল। পোল্যান্ড ডেনমার্কও অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি। যুক্তরাজ্যের শক্তি উপদেষ্টা সংস্থা ওয়াট-লজিকের দাবি, পাইপগুলি একেবারে নতুন, তাই জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই অবস্থায় নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপ লাইনে ফুটোর বিষয়ে তদন্ত করতে তৈরি হচ্ছে ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানি, সহ একাধিক দেশ।
সম্ভাব্য ক্ষতি কী কী?
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা বলেছেন এই পাইপে ফুটো হয়ে গ্যাস বেরিয়ে যাওয়ার অর্থ হল নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনগুলি আসন্ন শীতকালে ইউরোপে কোনও গ্যাস দিতে পারবে না। বড় মাপের ক্ষতি হয়ে থাকলে দুটি লাইনই স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর পাশাপাশি রয়েছে গুরুতর নিরাপত্তাগত এবং পরিবেশগত বিপদ। যে অঞ্চলে বাল্টিক সাগরের উপরিভাগে গ্যাসের বুদবুদ দেখা যাচ্ছে সেই অঞ্চলে প্রবেশ করলে জাহাজ ডুবে যেতে পারে। জলে এবং বাতাসে লিক হওয়া গ্যাসে আগুন জ্বলে উঠতে পারে।
রেকর্ড পরিমাণ মিথেন গ্যাস লিক
সবথেকে বড় কথা হল অত্যন্ত ক্ষতিকর গ্রীনহাউস গ্যাস মিথেন লিক করায় ওই এলাকার জলবায়ুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে চলেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলেছে, বাল্টিক সাগরের তলদেশে নর্ড স্ট্রিম প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তার ফলে একসঙ্গে যে পরিমাণ মিথেন গ্যাস লিক হয়েছে, তা সম্ভবত এখনও এর আগে কখনও রেকর্ড করা হয়নি। এই গ্রিনহাউস গ্যাস যা কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর, তবে স্বল্পস্থায়ী। বর্তমানে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন যথাসম্ভব কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ঘটনা সেই উদ্যোগের পরিপন্থী।
কেন রাশিয়াকে সন্দেহ করা হচ্ছে?
রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সেন্টার ফর মেরিটাইম অপারেশনের গবেষক অ্যান্ডার্স পাক নিলসেন বলেছেন, বাল্টিক সাগরের নীচে গ্যাসের পাইপে এই ফাটল ধরার সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একই সময়ে একটি নতুন গ্যাস পাইপের উদ্বোধন হচ্ছে। ওই পাইপলাইনের মাধ্যমে নরওয়ে থেকে পোল্যান্ডে গ্যাস আসার কথা। তাঁর মতে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে, নরওয়ের সেই গ্যাস পাইপেও এমন কিছু ঘটতে পারে এমন একটি সংকেত পাঠানো হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা হল, এর ফলে ইউরোপের গ্যাসের বাজারে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। আর এই বিশৃঙ্খলা থেকে বর্তমানে লাভবান হতে পারে একটিই দেশ, রাশিয়া।