জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে জুলাই মাসের ৭ তারিখের মধ্যে, অর্থাৎ মাত্র ৭ দিনে ২ হাজার ১৩৩ জন পাকিস্তানির পাসপোর্ট বাতিল করেছে সেদেশের সরকার। সরকারি নথি অনুযায়ী এরা সকলেই প্রফেশনাল বেগার বা পেশাদার ভিখিরি। আর এই পেশাদার ভিখারিদের নিয়ে পাকিস্তান সরকারের অবস্থা কার্যত ল্যাজে গোবরে। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্যি যে, পাকিস্তানের বড় শহরগুলোর অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই ওই শহরগুলোর ভিখারিদের হাতে।
কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের একটি সংবাদপত্র ‘দ্য ডন’-এ একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। ভিখিরি হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের জন্য চাকরির বিজ্ঞাপন। বেতন মাসে ১২ হাজার টাকা। টার্গেট ফুলফিল করলে ইনসেনটিভের ব্যবস্থার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে সেই বিজ্ঞাপনে। ওয়াক-ইন-ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন করা হবে। এই বিজ্ঞাপন বেরনোর পরের দিনই সেটা নিয়েই বড়সড় প্রতিবেদন ছেপেছে ওই পত্রিকা। সেই প্রতিবেদনে দাবি, পাকিস্তানে যাঁরা প্রথমবার চাকরির বাজারে নামছেন, তাঁদের বড় অংশের কাছেই পেশা হিসাবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নেওয়া ছাড়া কার্যত কোনও উপায় নেই। তাই লক্ষ লক্ষ যুবক এমনকি যুবতীরাও ‘বেগারস সিন্ডিকেট’-এ নাম লেখাচ্ছে। নতুন ভিক্ষা করতে নামা একজন যুবক বা বৃদ্ধ হেসেখেলে ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। আবার মহিলা বা অসুস্থ হলে সেই রোজগারের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই বেড়ে যায়। পাকিস্তানে চট করে কোনও চাকরিতে এত টাকা রোজগার করা কঠিন। আর এইসব ভিখারিদের রিক্রুটমেন্ট থেকে তাঁদের কাজকর্মের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন সিন্ডিকেট গজিয়ে উঠেছে।
এখানে জানিয়ে রাখা ভাল, পাকিস্তানের ভিখারিরা কিন্তু শুধু নিজেদের দেশেই ভিক্ষা করে এমন নয়। তারা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে ভিক্ষা করতে অভ্যস্ত। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই ট্রেন্ড চলছে। আর এই নিয়ে বহুবার পাকিস্তানের মুখ পুড়েছে। গত বছরই সৌদি আরব সাফ জানিয়ে দিয়েছিল হজযাত্রার নামে পাকিস্তান তাদের দেশে যেন ভিখারি না পাঠায়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীও জানিয়ে দিয়েছিল নির্মাণ শ্রমিকের বেশে পাকিস্তান থেকে দলে দলে ভিখারি তাদের দেশে আসছে। প্রবল সমালোচনার মুখে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংসদীয় কমিটি তৈরি করে পাক প্রশাসন। সেই রিপোর্টে উঠে আসে, গত ৫ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের ৯০ শতাংশই পাকিস্তানের নাগরিক। এমনকি ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে অবাধে মানবপাচার চলছে বলেও উঠে এসেছিল ওই রিপোর্টে। তারপরই পাক প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, নথিভুক্ত ভিখারি ছাড়া আর কেউ প্রকাশ্যে রাজপথে ভিক্ষা করতে পারবে না। করলে জরিমানা ও গ্রেফতারির মুখে পড়তে হবে। মুশকিল হল, ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে মরিয়া পাক নাগরিকদের একটি অংশ আইনের পরোয়াই করছেন না। ফলে, সেসব খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে। আসলে গত কয়েক বছরে পাক জনতা যে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁদের পক্ষে মরিয়া হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
লাহোর, করাচি ও ইসলামাবাদে এক প্যাকেট দুধের দাম আমস্টারডাম, ভিয়েনা কিংবা মেলবোর্নের থেকেও বেশি। এক লিটার ফুল টোনড দুধের দাম ৩৭০ টাকা। দুনিয়ার সব বড় শহরের থেকেও বেশি। গত সপ্তাহে পাক প্রশাসন দুধের উপর বাড়তি কর বসানোয় এই অবস্থা। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মেনে নিচ্ছেন, তাঁর সরকার অসহায়। আইএমএফের নির্দেশ মেনেই দুধের দাম বাড়াতে হয়েছে। গত মে মাসে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বড় মুখ করে বলেছিলেন, আর একবার মাত্র আইএমএফের কাছে হাত পাততে হবে। তারপর আর কোনওদিন আইএমএফের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না পাকিস্তানের। গত এপ্রিলেই আইএমএফের তৃতীয় ও শেষ কিস্তির ঋণ পেয়েছে শাহবাজ শরিফ প্রশাসন।আগামী অগাস্টের ভিতর ফের নতুন করে আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পাক প্রশাসন। এরপরও সেই আইএমএফ ছাড়া পাকিস্তানের গতি নেই।