ইসলামাবাদ: প্রতিবেশি দুই দেশ, অথচ, তাদের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে কত তফাৎ! এক দেশের একের পর এক রাষ্ট্রপ্রধান দেশকে ফাঁকি দিয়ে একের পর এক বিদেশি উপহার পকেটস্থ করেছেন। অপর দেশের প্রধান যা উপহার পান, তাই দেশের কল্যাণে দান করে দেন। বস্তুত, তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে ডুবতে বসা পাকিস্তানে এখন শোরগোল ফেলে দিয়েছে তোষাখানা মামলা। নিজের সম্পত্তির হিসেব দেওয়ার সময় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, বিদেশি অতিথিদের দেওয়া উপহারের হিসেব দেননি বলে অভিযোগ। সেই উপহারগুলি সরকারি তোষাখানায় জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই বাবদ কোনও অর্থও তোষাখানায় জমা করেননি বলে অভিযোগ করেছে বর্তমান পাক সরকার। রবিবার (১২ মার্চ), একেবারে ২০০২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত, তোষাখানাকে ফাঁকি দিয়ে পাক সরকারী পদাধিকারীরা কে কতটা উপকৃত হয়েছেন, তার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ইমরান খান একাই নন, তোষাখানা ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে বর্তমান পাক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, প্রয়াত সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশারফ – কেউই পিছিয়ে নেই। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, তোষাখানা থেকে কে কতটা কামিয়েছেন –
আসিফ আলি জারদারি
২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি, তৎকালীন পাক রাষ্ট্রপতি একটি সাদা রঙের বিএমডব্লু ৭৬০ এলআই (বুলেটপ্রুফ) গাড়ি উপহার পেয়েছিলেন। গাড়িটির মূল্য ছিল ২ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা। তবে জারদারি তোষাখানাকে ৪০ লক্ষ টাকার একটু বেশি অর্থ দিয়েই গাড়িটি নিজের দখলে রেখেছিলেন। ২০১১-র মার্চে একটি ১০ লক্ষ টাকা দামের হাতঘড়ি এবং অন্যান্য কিছু পণ্য, মাত্র ১,৫৮,২৫০ টাকা দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন। ওই বছরের জুনে ১২.৫ লক্ষ টাকা মূল্যের আরেকটি হাতঘড়ি তিনি নিজের কাছে রাখার জন্য তোষাখানায় ১,৮৯,২১৯ টাকা দিয়েছিলেন। অক্টোবরে ৩,২১,০০০ টাকা দিয়ে একটি ১০ লক্ষ টাকা দামের কার্টিয়ার হাতঘড়ি এবং একটি বন্দুক নিজের অধিকারে রেখেছিলেন।
নওয়াজ শরিফ
২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি উপহার পেয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। তার দাম ছিল ৪২.৫ লক্ষ টাকা। সরকারি নথি অনুযায়ী মাত্র ৬ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা দিয়ে সেই গাড়িটি নিজের কাছে রেখে দেন।
ইমরান খান
এবার আসা যাক ইমরান খানের কথায়। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ৩৮ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি ঘড়ি-সহ মোট পাঁচটি মূল্যবান হাতঘড়ি পেয়েছেন ইমরান। এই উপহারগুলি নিজের কাছে রেখে দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে তিনি ৭.৫৪ লক্ষ টাকা দিয়ে এই ঘড়িগুলি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। ওই বছর সেপ্টেম্বরে তিনি তোষাখানায় ২ কোটি টাকা দিয়ে সাড়ো ৮ কোটি টাকা দামের একটি ঘড়ি, ৫৬ লক্ষ টাক মূল্যের এক জোড়া কাফলিং, ১৫ লক্ষ টাকার একটি কলম এবং সাড়ে ৮৭ লক্ষ টাকা দামের একটি আংটি নিজের দখলে রেখে দিয়েছিলেন। এর কয়েকদিন পরই আবার তিনি উপহার পান ১৫ লক্ষ টাকা দামের আরেকটি রোলেক্স ঘড়ি। এর জন্য তিনি তোষাখানায় দিয়েছিলেন মাত্র ২,৯৪,০০০ টাকা। নভেম্বরে মাত্র ৩,৩৮,৬০০ টাকা পরিশোধ করে ইমরান খান ৯ লক্ষ টাকা মূল্যের আরেকটি রোলেক্স হাতঘড়ি এবং আরও কিছু মূল্যবান পণ্য নিজের কাছে রেখেছিলেন।
২০১৯-এর অক্টোবরে তিনি আরও একটি ঘড়ি পেয়েছিলেন, যার মূল্য ১৯ লক্ষ টাকা। সেটি নিজের কছে রাখার জন্য তোষাখানায় ৯,৩৫,০০০ টাকা পরিশোধ করেছিলেন ইমরান। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে, আরও একটি রোলেক্স ঘড়ি পেয়েছিলেন ইমরান। তার মূল্য ছিল ৪৪ লক্ষ টাকা। তার জন্য এবং অন্যান্য আরও কিছু উপহার নিজের কাছে রাখার জন্য ২৪ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী। ওই মাসেই তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি ১ কোটি টাকার একটি নেকলেস, ২৪ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি ব্রেসলেট, ২৮ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি আংটি এবং সাড়ে ১৮ লক্ষ টাকা মূল্যের এক জোড়া কানের দুল উপহার পেয়েছিলেন। ৯০ লক্ষ টাকা দিয়ে সেইসব উপহারগুলি ধরে রেখেছিলেন তিনি।
এবং নরেন্দ্র মোদী
পাক রাষ্ট্রনেতাদের এই তোষাখান লুন্ঠনের ছবির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ধরা পড়েছে ভারতে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তারপর থেকে গত ৯ বছরে বিদেশি অতিথিদের কাছ থেকে কম উপহার পাননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিন্তু তার কোনওটাই তিনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রাখেননি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তাঁর প্রাপ্ত সমস্ত উপহার নিলামে তোলেন। এই নিলাম থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি ব্যবহার করেন ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা নদী সংস্কারের মতো বহু জনহিতকর কাজে। উপহার নিলাম করে এখনও পর্যন্ত এই ধরনের কাজে ১০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দান করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। নিজের চিকিৎসার খরচও প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেন। সরকারি কোষাগারের অর্থ ব্যয় হয় না। খাবারের খরচও তিনি নিজেই দেন।
তবে, নরেন্দ্র মোদীর এই মানসিকতার পরিচয় তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই পাওয়া গিয়েছে। ২০০৪ সালে যখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পাওয়া উপহারগুলি শিশুকন্যাদের শিক্ষার কাজে ব্যবহার করতেন। ২০০১ সালে তিনি প্রথম গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকাকালীন তিনি মোট ১৯ কোটি টাকার উপহার পেয়েছিলেন। দুই দেশের রাষ্ট্রনেতাদের এই পার্থক্য থেকেই স্পষ্ট, কেন বর্তমানে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি আর পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে।