১০ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না যে বুর্জ খলিফা বা আল-সুদানে পুরুষ ও মহিলারা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, নাচানাচি করছেন। কিংবা দুবাইয়ের রাস্তায় বিদেশি গাড়ি ছোটাচ্ছেন কোনও মহিলা। এই সবই সত্যি হয়েছে একজনের দৌলতে। যিনি সৌদি আরবকে তেলের খনির বাইরেও নতুন এক পরিচয় দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কথা হচ্ছে মহম্মদ বিন সলমনের (Mohammed Bin Salman)। দুনিয়ার কাছে তিনি এমবিএস (MBS) নামেই পরিচিত। সৌদির বহু মানুষের কাছেই তিনি ঈশ্বরের সমান। কিন্তু পিছনে অনেকেই আবার বলেন, এমবিএস জল্লাদের থেকে কম কিছু নন। ভিশন ২০৩০ নিয়ে সৌদিকে এক স্বপ্নের দেশে পরিণত করছেন যিনি, তাঁকে নিয়ে এত জলঘোলা বা বিতর্ক কেন?
সৌদি আরব, যার শিকড়ে ক্ষমতা ও ঐতিহ্য মিশে, সেখানেই আধুনিক এক দেশ, যা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে, তার স্বপ্ন দেখেছিলেন এমবিএস। তাঁর উত্থান সিনেমার থেকে কম কিছু নয়। একাধারে তিনি যেমন সাহসী পদক্ষেপ করে প্রশংসিত, তেমনই আবার আবেগের বশে ভেসে হঠকারি সিদ্ধান্তের জন্যও চরম সমালোচিত। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অলিন্দে থাকলেও, তাঁর উত্থান রাতারাতিই হয়েছিল। যে যুবক নিজের দেশের সীমান্তের বাইরে কী রয়েছে, সে সম্পর্কেই বিশেষ জানতেন না, সেই-ই দেশের চিত্রটা পরিবর্তন করে দিতে প্রস্তুত হন।
১৯৮৫ সালের ৩১ অগস্ট জন্ম মহম্মদ বিন সালমানের। তাঁর বাবা ছিলেন সৌদি প্রিন্স সলমন বিন আজিজ আল সাউদ। তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তান এমবিএস। বয়সের ভারে যখন দুর্বল হচ্ছিলেন, তখনই বাবার সহকারী হয়ে ওঠেন মহম্মদ বিন সলমন। বাবার পিছনে বসে আইপ্যাডে নোট নিতেন সলমন। তিনি যে ভবিষ্যতে ক্রাউন প্রিন্স হবেন, তা কল্পনাতেও আসেনি কারোর।
২০০০ সালে বিশেষ পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ করা হয় এমবিএস-কে। ২০১৩ সালে ক্রাউন প্রিন্সের কোর্টের প্রধান হিসাবে নিয়োগ হন। সৌদির নিয়ম অনুযায়ী, এক ভাই থেকে পরবর্তী ভাইয়ের হাতে হস্তান্তরিত হয় ক্ষমতা। এমবিএসের ক্ষেত্রে তা হয়নি। সরাসরি বাবার হাত থেকে ক্রাউন প্রিন্সের ভার পায় এমবিএস। তাঁর খুড়তুতো দাদারা, যারা আদতে এই মুকুটের দাবিদার ছিলেন, তারাও এমবিএসের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।
শোনা যায়, বাবার সহকারী থাকাকালীনই ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এতটা উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন এমবিএস যে তিনি জ্যাঠা তথা তৎকালীন সৌদি সম্রাট আবদুল্লাহকে বিষ দিয়ে হত্যা করার জন্য রাশিয়া থেকে এক বিশেষ আংটি আনতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যেতেই রাজপরিবার থেকে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকী রাজার সঙ্গে হাত মেলানোও বারণ ছিল তাঁর।
শেষে বাদশাহ আবদুল্লাহ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে ২০১৫ সালে তাঁর ভাই তথা এমবিএসের বাবা সলমন সিংহাসনে বসেন। যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন এমবিএস। এমবিএস প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ হন। দায়িত্ব পাওয়ার পর পর তিনি যুদ্ধ শুরু করতে কোনও সময় নষ্ট করেননি।
এত দাদা, ভাইদের ভিড়ে রাজগদিতে নিজের জায়গা করে নেওয়া কঠিন, তা জানতেন এমবিএস। সেই কারণেই একদিন মধ্য রাতে সিনিয়র আধিকারিক সাদ আল-জাবরিকে ডেকেছিলেন। আড়ি পাতার ভয়ে বলেছিলেন ঘরের বাইরে মোবাইল রেখে আসতে। ঘরের ল্যান্ডফোনের তারও ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। আধ ঘণ্টার যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা তিন ঘণ্টা ধরে চলে। সেখানেই জাবরি-কে এমবিএস জানান কীভাবে সৌদিকে বদলে ফেলতে চান তিনি। জানান, বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি, আরামকোর একটি অংশ বিক্রি করে দিতে চান। তেলের উপরে সৌদির অর্থনীতির যে নির্ভরশীলতা, তা থেকেই বের করে আনতে চেয়েছিলেন। এর বদলে সিলিকন ভ্যালির বিভিন্ন সংস্থায় বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখান।
এমবিএসের এই চিন্তাধারায় মুগ্ধ হয়েছিলেন জাবরি। জানতে চেয়েছিলেন, কোথা থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন এত কিছু করার? উত্তরে শান্ত গলায় সলমন বলেছিলেন, “আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের নাম শুনেছেন?” এমবিএসের এই উত্তরেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তিনি ইতিহাস গড়বেন।
সৌদির জনগণের একাংশের মতে, ক্রাউন প্রিন্স ঈশ্বরের সমান। ক্ষমতায় বসার পর তাঁর অন্যতম সাফল্য ছিল মহিলাদের ক্ষমতায়ন। ২০১৮ সালে মহিলাদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেন। ঘর থেকে বের করে এনে, মহিলাদের কাজের স্বাধীনতা ও অধিকারও দেন এমবিএস। জানান, মহিলাদের কাজের স্বাধীনতা দিয়ে, দেশে ৬০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান করা হবে।
উবারের মতো সিলিকন ভ্যালির বিভিন্ন সংস্থায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখান। শুধুমাত্র তেল উৎপাদন ও বিক্রি দিয়ে দেশের অর্থনীতি চলত সৌদি আরবে। সেই নির্ভরশীলতা থেকেই দেশকে বের করে আনতে চেয়েছেন এমবিএস।
২০৩৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য বিড করছে সৌদি আরব। এর জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করছে সৌদি। বিশ্বমানের খেলাধুলোয় জোর দেওয়া হচ্ছে। টেনিস, গল্ফের মতো টুর্নামেন্ট আয়োজনেও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে।
রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে, এমনটাই ধারণা ছিল সকলের। কিন্তু ২০১৭ সালে এই ধারণা বদলে দেন এমবিএস। তৈরি করেন একটি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, যার নেতৃত্বে তিনি নিজেই ছিলেন। আর কমিটি গঠনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালাল সহ ১১ জন যুবরাজ, ৪ জন মন্ত্রী ও ১০ জন প্রাক্তন মন্ত্রীকে গ্রেফতারির নির্দেশ দেন। তাঁদের আটক করে রাখা হয় রিয়াধের রিটজ় কার্লটন হোটেলে! হ্যাঁ, সৌদির রাজাদের জন্য এই সাত তারা হোটেলই জেলখানায় পরিণত হয়েছিল।
২০১৭ সালে এমবিএস-র হয়ে এক ব্যক্তি ৪৫ কোটি ডলারের বিনিময়ে সালভাতর মুন্ডি নামের ৫০০ বছরের পুরনো একটি ছবি কেনেন। এটি এখনও পর্যন্ত বিক্রি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামী শিল্পকর্ম। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা এই ছবিতে যিশু খ্রিস্টকে স্বর্গ ও পৃথিবীর কর্তা হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ল্যাটিন শব্দ সালভাতর মুন্ডির অর্থ, “বিশ্বের ত্রাণকর্তা”।
কিন্তু নিলামের পর প্রায় সাত বছর ওই শিল্পকর্ম সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, এমবিএসের প্রাসাদে বা ইয়টে ঝোলানো রয়েছে এই ছবি। পরে জানা যায়, ছবিটি জেনেভায় সংরক্ষণাগারে রাখা রয়েছে। এমবিএস রিয়াধে একটি জাদুঘর তৈরি করতে চান, সেখানেই বিশ্বের সবথেকে দামী ছবিটি ঝোলাবেন।
একদিকে যেমন পুরনো ইসলাম রীতি ভেঙে বেরিয়ে এসে আধুনিক সৌদি গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দেশকে, সেখানেই এমবিএসের বিরুদ্ধে স্বৈরাচার, হঠকারি সিদ্ধান্ত ও নৃশংসতারও ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। ক্রাউন্স প্রিন্স হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই ২০১৮ সালে ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এমবিএস। তিনি মনে করতেন, হুথিরা ইরানের প্রতিনিধি। আর সৌদির সঙ্গে ইরানের আদায় কাচকলায় সম্পর্ক। সেই কারণেই যুদ্ধ ঘোষণা করতে দু’বারও ভাবেননি এমবিএস। এই যুদ্ধ ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে এমবিএসের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধই যুবরাজকে সৌদির ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে তুলে ধরে।
যদিও এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত হঠকারী এবং ভুল বলেই আখ্যা দিয়েছিলেন এমবিএসের ঘনিষ্ঠরা। সৌদি আরব যেখানে দীর্ঘ পর্যালোচনার পর কোনও সিদ্ধান্ত নিত, সেখানেই এমবিএস ১২ ঘণ্টায় যুদ্ধের ঘোষণা করেছিলেন। আবেগের বশেই সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস, এমনটাই সমালোচকদের মত। হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নিয়ে হোয়াইট হাউসের তরফেও সতর্ক করা হলেও, তাতে কান দেননি এমবিএস।
সৌদির প্রতিরক্ষা কর্তা আল জাবির এও অভিযোগ করেছিলেন যে ইয়েমেনে যুদ্ধ করতে এমবিএস তাঁর বাবার স্বাক্ষর নকল করে সেনা পাঠানোর ডিক্রি জারি করেছিলেন।
তবে এমবিএসের কেরিয়ার গ্রাফে সবথেকে কালো অধ্যায় হল ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তানবুলে সৌদি কনসুলেটের ভিতরেই সৌদির এজেন্টরা খারগোজিকে হত্যা করে। টুকরো টুকরো করা হয় দেহের হাড়ও, যার কোনও হদিস মেলেনি এখনও।
জানা যায়, ১৫ সদস্যের হিট স্কোয়াড কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে ইস্তানবুলে গিয়েছিলেন খাশোগজিকে হত্যা করতে। ওই হিট স্কোয়াডে এমবিএসের কয়েকজন নিজস্ব দেহরক্ষীও ছিল। এই নিয়ে বিশ্বজুড়েই শোরগোল পড়ে গেলে, হত্য়ার দায়ভার নিলেও, এর অর্ডার দেননি বলেই দাবি করেন এমবিএস। ২০২১ সালে মার্কিন গোয়েন্দারা দাবি করেন যে সাংবাদিক হত্যায় সরাসরি যোগ ছিল এমবিএসের।