ঢাকা: “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!” ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার কণ্ঠে অনুরণিত হচ্ছে এই স্লোগান। রবিবার (২১ জুলাই), বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে মাত্র ৭ শতাংশ সংরক্ষণ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে জুলাইয়ের শুরু থেকে চলা কোটা বতিলের দাবিতে হওয়া আন্দোলন বন্ধ হবে। গত সোমবার থেকে এই আন্দোলনকে ঘিরে প্রাণ গিয়েছে অন্তত ১৫০ মানুষের। যার অধিকাংশই ছাত্রছাত্রী। আন্দোলন যদি স্তিমিত হয়েও যায়, রাজাকার স্লোগান নিয়ে চর্চা খুব শিগগিরই থামবে বলে মনে হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর, তার জায়গায় ‘রাজাকার’ পরিচয় দিয়ে স্লোগান দেওয়া নিয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
রাজাকার পরিচয় নিয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘গর্ববোধ’, ‘উচ্ছ্বাসে’ অনেকেই বিরক্ত। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একাংশ রাজাকারদের নামে জয়ধ্বনি দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এই স্লোগান দেওয়াকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলেছে। এই প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনকারীদের এই স্লোগান দেওয়া নিয়ে বিস্মিত। তিনি বলেছেন, “রোকেয়া হল থেকে বেরিয়ে মেয়েরা স্লোগান দিচ্ছে আমরা রাজাকার। এরা কারা? রাজাকারদের নামে জয়ধ্বনি দিতেও তাদের বাধে না।’
চেয়েছিলাম অধিকার
বানিয়ে দিলো রাজাকার 😪তুমি কে?
আমি কে?
রাজাকার রাজাকার!! 😭 pic.twitter.com/J1ksY405Jw— 🎆নীলতারা🎇 (@Rahamatullah778) July 15, 2024
আবার আন্দোলনকারীদের পাল্টা দাবি, তাঁদের ‘রাজাকার’ তকমা দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। আসলে, গত সোমবার চিন থেকে ফিরে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটার সুবিধা পাবে না তো কি রাজাকারদের নাতি-নাতনিরা পাবে?” এরপর থেকেই শোনা গিয়েছিল এই বিতর্কিত স্লোগান। স্লোগানের পরের অংশে অবশ্য বলা ছিল, “চাইতে গেলাম অধিকার, তকমা জুটল রাজাকার।” অর্থাৎ, আন্দোলনকারীদেরও রাজাকার তকমা নিয়ে গর্ববোধ নেই। বরং প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে রয়েছে অভিমান। যদিও, বাংলাদেশি সুশীল সমাজের একাংশ দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রী মোটেই আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেননি। তাঁর মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট, রাজাকার শব্দটা বাংলাদেশের কোনও পক্ষেরই পছন্দ নয়। বস্তুত, আধুনিক বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ আখ্যা দেওয়াটাই সবচেয়ে জঘন্য অপবাদ ও অসম্মান। কিন্তু কেন? কারা ছিল এই রাজাকার? কী তাদের ইতিহাস? কেন তারা এত ঘৃণিত বাংলাদেশে?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘রাজাকার’রা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের এক আধাসামরিক বাহিনী। তারা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী। পাক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা গণহত্যা, ধর্ষণ এবং আরও নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটিয়েছিল বাংলাদেশে। তবে মজার বিষয় হল, এই শব্দটির উদ্ভব বাংলাদেশে নয়। স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের হায়দরাবাদে। সেখানে অবশ্য শব্দটা ছিল রেজাকার। আরবি শব্দ রেজাকারের অর্থ স্বয়ংসেবক। ভারতের সঙ্গে যাতে নিজামের রাজ্য হায়দরাবাদ কোনওভাবেই একত্রিত না হয়, সেটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৯৩৮ সালে মজলিশ-এ-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিন নেতা বাহাদুর ইয়ার জং এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৪৬-এ তাঁর মৃত্যুর পর রেজাকার বাহিনীর নেতা হন কাশিম রিজভি। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, এক বছর পর্যন্ত নিজামকে রক্ষা করাই ছিল এই সশস্ত্র বাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য। দেশ স্বাধীন হতেই কাশিমের নির্দেশে নির্বিচারে অত্যাচার শুরু করেছিল রেজাকার বাহিনী। হিন্দুদের পাশাপাশি ভারতপন্থী মুসলিমদেরও তারা নিশানা করেছিল। আতঙ্কের অপর নাম হয়ে উঠেছিল এই বাহিনী। ‘অপারেশন পোলো’য় রেজাকারদের পরাজিত করেছিল ভারতীয় সেনা। কাসিম রিজভী পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন।
এই রেজাকারই বাংলাদেশে এসে অপভ্রংশে হয় রাজাকার। ১৯৭১ সালের মে মাসে, জামাতে ইসলামীর নেতা, মৌলানা আবুল কালাম মহম্মদ ইউসুফ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলেন। মূলত পাকিস্তানপন্থী বাঙালি এবং উর্দুভাষী বিহারীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই বাহিনী। আর এই বাহিনী গঠনের পিছনে ছিল পাক জেনারেল টিক্কা খানের মস্তিষ্ক। পাক সামরিক বাহিনীকে, বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল তারা। এর বদলে পাক বাহিনীর কাছ থেকে মাসে দেড়শো টাকা (সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বড় অঙ্কের অর্থ) করে ভাতা পেত তারা। সরকারের হয়ে তারা দুইভাবে কাজ করত। একদল পাকিস্তানের সপক্ষে সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করত। আর একদল সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করত, হত্যা করত। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে পাক সেনার হাতে তুলে দিত রাজাকাররা।
সেই সব ঘটনার ক্ষত এখনও বাংলাদেশিদের মনে টাটকা। ফলে, রাজাকারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা থাকাটাই স্বাভাবিক। ২০১০ সালে, হাসিনা সরকার একাত্তরের যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য এক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সময় থেকে এই ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকজনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তারা প্রধানত বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন জামাতে ইসলামী দলের সদস্য। ২০১৩ সালের মে মাসে গ্রেফতার করা হয় রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা তথা জামাতে ইসলামির শীর্ষ নেতা ইউসুফ-কে। তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তবে ২০১৪-য় বন্দি অবস্থাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে, হাসিনা সরকার রাজাকারদের ১০,৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। কাজেই তকমা হোক বা স্লোগান, ‘রাজাকার’ শব্দটা নিয়েই বাংলাদেশে ধুন্ধুমার হওয়াটা স্বাভাবিক।