যে কোনও বাজেটই অর্থনীতি আর তৎকালীন রাজনৈতিক প্রয়োজনের একটি ন্যায়সঙ্গত মিশ্রণ। এবারের বাজেট ঠিক এমনই হবে। আসলে এবারের বাজেট রাজনৈতিক প্রয়োজনের দিকে একটু বেশিই ঝুঁকে থাকবে, কারণ বাজেট পেশ হওয়ার ১০ দিনের ভেতরই কিছু রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে। শাসকদল বিজেপির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশ, যেখানে যুবসম্প্রদায়, শ্রমিক আর কৃষকরা লাগাতার আন্দোলন করে চলেছে। কৃষক আর তরুণদের পরিবার ছাড়া রাজ্যের অধিকাংশ জনসংখ্যাই কোনও না কোনওভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এই কারণে বাজেটে এই গোষ্ঠীদের চিন্তা দূর করার সম্ভাবনা অবশ্যই থাকবে।
বর্তমান বাজেটে আয়, কর্মসংস্থান আর বেসরকারিকরণ প্রধান বিষয়। সাম্প্রতিক বেশকিছু সমীক্ষায় এই বিষয়টা সামনে উঠে এসেছে যে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ স্তরে তো রয়েইছে, অন্যদিকে করোনার কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ, যাদের মধ্যে কৃষক আর শ্রমিকরাও শামিল রয়েছেন, তাদের আয়ও হ্রাস হয়েছে। ২০১৫-১৬-র তুলনায় এখন কম সে কম ৬০ শতাংশ মানুষ গরীব। যারা বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী, রান্নার গ্যাস এবং কিছু নগদ অর্থের লাভ তো অবশ্যই পেয়েছেন, কিন্তু এই ব্যবস্থাও করোনার সমস্যার চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ প্রমাণিত হতে পারেনি।
আধিকারিকভাবে ২০২১-২২ এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের জিডিপি ২০১৯-২০-র স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি অসংগঠিত আর যোগাযোগ পরিষেবার ব্যাপারে বলা যাবে না। এটাই কারণ যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় তৃতীয় ঢেউ দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সমস্যা যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। অর্থনীতির সংগঠিত ক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিশ্বাস আর ক্ষমতা ব্যবহারের হার মহামারীর আগের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। এটাই কারণ অর্থনীতির উন্নতি ধীরে ধীরে হচ্ছে। ২০২২-২৩ এর বাজেটে এই বিষয়গুলির উপর মনোযোগ দেওয়া জরুরী।
যে কোনও বাজেট থেকেই এটা আশা করা হয় যে সেটি তৎকালীন সমস্যা দূর করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্যও পরিকল্পনা তৈরি করবে। কারণ যে সমস্যার মুখোমুখী হতে হচ্ছে, তা বেসিক সমস্যা, এই কারণে বাজেটের আকারকে পর্যাপ্তভাবে বাড়াতে হবে। ২০২১-২২ এ, ২০২০-২১ এর সংশোধিত অনুমানের তুলনায় বাজেটের আকার সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এছাড়া, সরকার বরাদ্দ অর্থকে আক্রামণাত্মকভাবে খরচও করেনি। উহাহরণ স্বরূপ, নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান জানান দেয় যে পুঁজিগত ব্যয় যথেষ্ট পেছিয়ে রয়েছে। এখন যখন মূল্যবৃদ্ধি চরমে রয়েছে, বাস্তবিকভাবে সরকার নিজের লক্ষ্য থেকে যথেষ্ট পেছিয়ে রয়েছে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি আর কর্পোরেট মুনাফা আর সংগঠিত ক্ষেত্রের বৃদ্ধির কারণে কর সংগ্রহ বেড়েছে। যদি এই সমস্ত কারণকে একযোগে দেখা যায় তো এটা বলা যেতে পারে যে নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত যে রাজকোষীয় লোকসান হওয়া উচিৎ ছিল, তা থেকে যথেষ্ট কম। কিন্তু এটা কোনও ভাল কথা নয়, কারণ সরকারের কাছ থেকে অর্থনীতির যে আশানুরূপ উৎসাহ পাওয়া উচিৎ ছিল তা পাওয়া যায়নি।
২০২২-২৩ এর বাজেট কী দিতে পারে?
লাগাতার বজায় থাকা মূল্যবৃদ্ধির কারণে ২০২২-২৩ বাজেটের আকার যথেষ্ট বাড়াতে হবে। যাতে বাস্তবিকভাবে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের জন্য আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা যেতে পারে। যাতে না শুধু সংশ্লিষ্ট সেক্টর বরং সমগ্র অর্থনীতিই উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। কর্মসংস্থানকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য মনরেগা, গ্রামীণ বেসিক পরিকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রের জন্য অধিক বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। গ্রামীন রোজগার গ্যারান্টির মতো শহুরে এলাকার জন্য কোনও রোজগার তৈরির স্কিমের ঘোষণা করতে হবে। মূলধণ বৃদ্ধির কারণে কৃষি ক্ষেত্রে আয়ের সংকট দূর করতে হবে।
ফসলের বীজ, সার ইত্যাদির দাম দ্রুতগতিতে বেড়েছে, এই কারণে বেশি ভর্তুকিযুক্ত বাজেটের প্রয়োজন পড়বে। মাইক্রো সেক্টরকে কার্যকরী পুঁজি প্রদান করতে হবে, কারণ এটা এমএসএমই রোজগারের ৯৭.৫ শতাংশ রোজগার প্রদান করে আর এই ক্ষেত্রটি সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এটিকে ছোট আর মাঝারি মাপের ক্ষেত্র থেকে আলাদা করারও প্রয়োজন রয়েছে, কারণ এই এই ক্ষেত্র এমএসএমইকে দেওয়া সমস্ত ছাড় কেড়ে নেয়। এর সঙ্গেই ক্রিপ্টোর সমাধানের ব্যাপারেও কিছু ঘোষণা করতে হবে, কারণ এটা অর্থনীতির বাজার আর ব্যাঙ্কগুলিকে অস্থির করে তুলতে পারে।
প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে
উপযুক্ত যোজনাগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের প্রয়োজন পড়বে, অন্যথায় রাজকোষের লোকসান যথেষ্ট বেড়ে যাবে। অপ্রত্যক্ষ করের ব্যবহার করা যাবে না, কারণ এটা মু্দ্রাস্ফীতির ফলে তৈরি হওয়া মন্দা। বর্তমান নিরাশাজনক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ খুব ভাল চিন্তা হবে না। এই অবস্থায় একমাত্র স্রোত যা বাকি থাকে তা হল অপ্রত্যক্ষ কর। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন সম্পন্ন শ্রেণি ভাল প্রদর্শন করেছে। উচ্চ রাজকোষীয় লোকসান আর সম্পত্তি করের পাশাপাশি সম্পত্তি শুল্ক আর উপহার কররের একটি বিবেকযুক্ত মিশ্রণ জরুরী। করোনা মহামারী আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে যে আমরা একটি গোষ্ঠী। যারা করকে গরীবদের বিতরণ হিসেবে ভাবে, তারা অদূরদর্শী, কারণ যদি গরীবরা বেশি পায় তাহলে চাহিদা পুণর্জীবিত হবে আর ধনীরা তার লাভ পাবে।
(লেখক ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্সে ম্যালকম আদিশেশোয়া চেয়ার প্রফেসর আর জেএনইউতে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন)