লখনউ: চলে গেলেন ‘সাহারাশ্রী’। হ্যাঁ, ‘সাহারা ইন্ডিয়া পরিবার’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত রায়কে ভালবেসে এই নামেই ডাকতেন তাঁর কর্মীরা। ‘সাহারা ইন্ডিয়া পরিবার’-এর নতুন করে পরিচয়ের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ১৯৭৮ সালে এই শিল্প সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুব্রত রায়। কথায় বলে, ‘বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হয় না’। এই প্রবাদবাক্যকে ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন তিনি। অ্যাম্বি ভ্যালি সিটি, সাহারা মুভি স্টুডিও, এয়ার সাহারা, উত্তর প্রদেশ উইজার্ডস, ফিল্মি ইত্যাদির মতো বহু ক্ষেত্রে ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের। ভারত জুড়ে এই গোষ্ঠীর ৫,০০০-এরও বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অবশ্য লগ্নিকারীদের টাকা মেটাতে গিয়ে বেশ কিছু সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে। তবে, ২০০৪ সালে সাহারা গোষ্ঠীকে টাইম ম্যাগাজিন ‘ভারতীয় রেলওয়ের পরে ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম নিয়োগকর্তা’র সম্মান দিয়েছিল। বাঙালি হলেও সাহারা কর্তার জন্ম হয়েছিল বিহারের এক ছোট জেলায়। আসুন জেনে নেওয়া যাক, সেখান থেকে সুব্রত রায়ের সাহারাশ্রী হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য যাত্রার কথা।
সুব্রত রায়ের জন্ম
১৯৪৮ সালের ১০ জুন, বিহারের আরারিয়ায় জেলায় জন্মেছিলেন সুব্রত রায়। বাবা সুধীরচন্দ্র রায়, মা ছবি রায়। পরবর্তীকালে কাজের সন্ধানে উত্তর প্রদেশের গোরখপুরে চলে এসেছিল সুধীরচন্দ্র রায়ের পরিবার। বাবা-মা ও ভাইবোনকে নিয়ে তুর্কমানপুর এলাকার এক বাড়িতে থাকতেন সুব্রত।
উজ্জ্বল ছাত্র
শৈশব থেকেই অত্যন্ত উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন সুব্রত রায়। কলকাতার হোলি চাইল্ড স্কুলে পড়তেন। শুরু থেকেই কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। স্কুলশিক্ষা শেষ করে গোরখপুরের গভর্নমেন্ট টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেছিলেন।
ল্যামব্রেটা স্কুটারে নোনতা খাবার বিক্রি
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে প্রথমে আর পাঁচজন বাঙালির মতো সুব্রত রায়ও প্রথমে চাকরিই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আচমকা বাবার মৃত্যু তাঁর জীবন অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছিল। কঠিন পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে যৌবনে তিনি একটি ল্যামব্রেটা স্কুটারে গোরখপুরের রাস্তায় নিমকি-চাবনাচুরের মতো নোনতা খাবার বিক্রি করতেন। তবে, প্রথম থেকেই সফল উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার ইঙ্গিত ছিল। তাঁর বিক্রি করা পণ্যগুলির ব্র্যআন্ডের নাম দিয়েছিলেন ‘জয়া প্রোডাক্টস’। সেই ল্যামব্রেটা স্কুটারটি এখন রাখা আছে লখনউয়ের আলিগঞ্জে সংস্থার সদর দফতর, সাহারা ভবনে। একটি কাচের কিউবিকেলে সেটি সংরক্ষণ করা হয়েছে সাহারা ইন্ডিয়ার কর্মীদের অনুপ্রেরণা দিতে।
সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের শুরু
১৯৭৮-এ পথ চলা শুরু হয়েছিল সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের। গোরখপুরে তাঁর সেভিংস এবং প্যারা-ব্যাঙ্কিংয়ের ব্যবসার জন্য ছোট একটি অফিস খুলেছিলেন সুব্রত রায়। ৪২ জন লগ্নিকারী নিয়ে শুরু হয়েছিল সাহারা ইন্ডিয়া ফিন্যান্সিয়াল। লগ্নিকারীদের অধিকাংশই ছিলেন দিনমজুর। দৈনিক মজুরির ২০ শতাংশ তাঁরা সাহারায় বিনিয়োগ করতেন। কর্মী ছিলেন মাত্র ৩ জন। আর বর্তমানে তাদের কর্মী সংখ্য়া ১২ লক্ষেরও বেশি। সাহারা সাম্রাজ্য় হয়ে ওঠার পরও সাহারা ইন্ডিয়া জনগণের সংস্থাই রয়ে গিয়েছে। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বা চেয়ারম্যান-এর পরিবর্তে সংস্থায় নিজেকে বরাবর ‘প্রধান কর্মী’ বলে এসেছেন সুব্রত।
মানবিক উদ্যোগ
মানবিক প্রয়োজনেও বারবার সাড়া দিতে দেখা গিয়েছে সুব্রত রায় তথা সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারকে। কার্গিল শহিদদের ১২৭টি পরিবারকে তিনি আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী পর্যন্ত তাঁর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিলেন। ২০১৩ সালে বন্যা বিধ্বস্ত উত্তরাখণ্ডে ত্রাণ তহবিলেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর।
জেল যাত্রা
২০০৮ সালে বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করার অভিযোগ তোলে। শুরু হয় সেবির সঙ্গে সাহারা ইন্ডিয়ার আইনি বিরোধ। ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল সুব্রত রায়ের। কিন্তু, তিনি আসেননি। ফলে আদালত তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় এবং তার জায়গা হয়েছিল দিল্লির তিহার জেলে। ২০১৬ সালের মে মাস থেকে অবশ্য বিভিন্ন কারণে জামিনে মুক্তি পান এবং আমৃত্য়ু জেলের বাইরেই ছিলেন। সাহারাকে ভারতে তাদের সম্পত্তির একটি অংশ বিক্রি করে লগ্নিকারীদের অর্থ মেটানোর অনুমতি দেওয়া হয়ে। সুব্রত রায় অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছিলেন, সনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন বলেই কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তাঁকে হেনস্থা করছে কংগ্রেস।
প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা
সেবির ধাক্কার পরও প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছিলেন সুব্রত রায়। ভারতে অনলাইন শিক্ষার ব্যবসায় প্রবেশ করার পরিকল্পনা করেছিলন। লক্ষ্য ছোট শহর এবং গ্রাম। ভারত এবং বিদেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের সদস্যদের নিয়ে তিনি একটি দলও তৈরি করেছিলেন। প্রোগ্রামের রুট ম্যাপ প্রস্তুত করেছিলেন। ১৪,০০০ ঘন্টার লেকচারও তৈরি করা হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছিল। এছাড়া, ২০১৯-এর জুনে সুব্রত রায় ‘সাহারা ইভোলস’ নামে সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের একটি নয়া ব্র্যান্ডের ঘোষণা করেছিলেন। বৈদ্যুতিক যানের মাধ্যমে অটোমোবাইল সেক্টরে আসতে চেয়েছিলেন। এই দুই উদ্যোগেরই কাজ চলছে। সাহারাশ্রী চলে গেলেও, সেই কাজ থেমে থাকবে না বলেই আশা করা যায়।
বিতর্ক সত্বেও ভারতের অন্যতম সফল শিল্পপতি হিসেবেই বিবেচিত হবেন সুব্রত রায়। তাঁর জীবন কাহিনী সমস্ত উদ্যোগপতিদের জন্যই অনুপ্রেরণার। স্কুটারে করে নোনতা খাবার বিক্রি করা থেকে ১২ লক্ষ কর্মীর সাহারা পরিবার গঠন করার অবিশ্বাস্য যাত্রা, পথ দেখাতে পারে নতুন উদ্যোগপতিদের। সঠিক পরিশ্রম এবং অপরিমেয় অধ্যবসায় যে কোনও উদ্যোগকে কোন পর্যায়ে নিয়েযেতে পারে, সাহারাশ্রী তার সবথেকে বড় উদাহরণ।