নয়া দিল্লি: কেন্দ্র যে ডিজিটাল কারেন্সি (Digital Currency) আনতে চলেছে, তেমন ইঙ্গিত আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। সম্প্রতি ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের (Nirmala Sitharaman) কথায় তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। নির্মলার ঘোষণা, ‘ডিজিটাল রুপি’ (Digital Rupee) নামে এক ডিজিটাল মুদ্রা শীঘ্রই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (RBI) দ্বারা জারি করা হবে। ভারতে যখন প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ করা নিয়ে তুমুল জল্পনা ছড়িয়েছে, ঠিক সেই সময়েই এই ডিজিটাল মুদ্রার ঘোষণা বাজেটে। যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখনই কিছু করা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এই ক্রিপ্টোর ট্রেডিং এবং এনএফটির মতো ভার্চুয়াল ডিজিটাল সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ের উপর ৩০ শতাংশ কর চাপানো হবে। আপাতভাবে সরকারের যা দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত সরকার চায় মানুষ এই ক্রিপ্টোকারেন্সির বদলে স্বদেশি ডিজিটাল রুপি ব্যবহার করুক। তবে এই ডিজিটাল মুদ্রা বিষয়টি ঠিক কী? বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ডিজিটাল মুদ্রার কথা বলার পর থেকে অনেকের মনেই এই কথা শোনা যাচ্ছে। আর সবথেকে বেশি যেটা ভাবাচ্ছে তা হল ডিজিটাল রুপিও কি বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মতো একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি?
ডিজিটাল রুপি বুঝতে গেলে সবার আগে বুঝতে হবে সিবিডিসি বিষয়টি। সিবিডিসি কথাটির অর্থ হল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল মুদ্রা। এটি হল মূলত এক ধরনের ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মুদ্রা, যা সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে জারি করা হয়। যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হল আরবিআই। আর আরবিআইয়ের হাতে এমন একটি ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করার ক্ষমতা রয়েছে। এই মুদ্রা অনেকটাই কাগজের নোটের (ফিয়াট কারেন্সি) মতোই, তবে এটিকে আপনি হাতে গুণতে পারবেন না। এখন আরবিআই যখন ডিজিটাল রুপি চালু করার পথে এগোচ্ছে, তখন এটা স্পষ্ট যে এই ডিজিটাল রুপিটি হবে ভারতের সিবিডিসি এবং বর্তমান প্রচলিত মুদ্রার (ফিয়াট কারেন্সি) ডিজিটাল সংস্করণ হিসেবে বিবেচিত হবে। লেনদেনেও ব্যবহার করা যাবে। বাজেট পেশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে।
সম্ভবত, ২০২২-২৩ সালের মধ্যেই আইবিআইয়ের তরফে এক ডিজিটাল রুপি চালু করা হবে। এটি মূলত ভারতের সরকারি মুদ্রার এক ডিজিটাল টোকেন হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আরবিআই এই ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করবে ও যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করবে। ২০২২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেনে, ব্লক চেন এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলবে আরবিআইয়ের ডিজিটাল রুপি। তবে, আরবিআই কীভাবে ডিজিটাল রুপি বাস্তবায়ন করতে চলেছে এবং এটি কী ধরনের ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করতে চলেছে তা এখনও জানা যায়নি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই ডিজিটাল রুপি অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, ইত্যাদির সঙ্গে ইন্টার-অপারেবল হবে কিনা তাও স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি।
কেন্দ্রীয় বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী, ভারত সরকার ২০২২-২৩ সালের মধ্যে কোনও এক সময় ডিজিটাল রুপি প্রকাশ করতে চলেছে। উল্লেখ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এর আগে ২০১৯ সাল থেকে নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার কথা ভাবছিল। কিন্তু এখন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ হয়ে গিয়েছে। সব ঠিক থাকলে, এই বছর অথবা আগামী বছরের শুরুতেই এই ব্লক চেন ভিত্তিক ডিজিটাল রুপি আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
প্রথমত ডিজিটাল রুপি এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির মধ্যে এক মৌলিক ফারাক রয়েছে। তা হল – ডিজিটাল রুপি হল সেন্ট্রালাইজড এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মতো জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির ক্ষেত্রে কোনও সেন্ট্রালাইজড মডেল নেই। অর্থাৎ, এর উপর কোনও একক প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। আরবিআই ডিজিটাল রুপি ইস্যু করছে। তবে অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিতে এমন কোনও ইস্যু করার প্রতিষ্ঠান নেই।
আরও একটি বড় পার্থক্য হল যে ডিজিটাল রুপি অর্থের ট্রেইল তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, একটি লেনদেনের ক্ষেত্রে তার যাবতীয় তথ্য খুঁজে বের করতে পারে এই ডিজিটাল রুপি। কে অর্থ পাঠাচ্ছেন, কার কাছে পাঠাচ্ছেন – এই তথ্য হাতে আসার ফলে ডিজিটাল রুপির জন্য প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে। ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির ক্ষেত্রে কেবব এনক্রিপ্ট করা নম্বর এবং অক্ষরের দীর্ঘ স্ট্রিং পাওয়া যায়। আর এই পার্থক্যটাই ক্রিপ্টোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিজিটাল রুপিকে আলাদা করে তোলে। এখন দেখার বাজারে চলতি জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডিজিটাল রুপি কতটা জায়গা করে নিতে পারে!
ডিজিটাল রুপি এবং ডিজিটাল ক্যাশের মধ্যে প্রযুক্তিগত পার্থক্য রয়েছে। সম্প্রতি, এক বক্তৃতায়, আরবিআই-এর ডেপুটি গভর্নর টি রবি শঙ্কর, ডিজিটাল রুপি এবং ইউপিআই-এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে, “সিবিডিসি-র ক্ষেত্রে অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের তুলনায় কিছু সুস্পষ্ট সুবিধা রয়েছে। সিবিডিসি ব্যবহারে ঝুঁকি অনেকটা কম। এমন একটি ইউপিআই ব্যবস্থার কথা ভাবুন, যেখানে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের পরিবর্তে সিবিডিসির লেনদেন করা হয়। সেক্ষেত্রে দুটি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে আর্থিক নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয়তা থাকে না। সিবিডিসি ব্যবস্থা আর্থিক লেনদেনেরে ব্যবস্থাকে আরও রিয়েল-টাইম করে তুলবে।”
সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, “একজন ভারতীয় যখন কিছু আমদানি করছেন, তিনি আমেরিকান রফতানিকারককে কোনও মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন ছাড়াই ডিজিটাল ডলারে রিয়েল-টাইম লেনদেন করতে পারবেন৷ এই ক্ষেত্রে লেনদেনের জন্য মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের থেকে কোনওরকম নিষ্পত্তির প্রয়োজন থাকবে না। আর্থিক বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে টাইম জোনের পার্থক্য আর কোন ব্যাপার হবে না।”
ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির মতো এই নতুন ব্যবস্থাগুলিকে নিয়ে বিশ্বের তাবড় দেশগুলিও যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছে। কারণ, এই মুদ্রাকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা সেই লেনদেন কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে… কিছুই জানা সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার উদ্বিগ্ন যে, এই ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ, জঙ্গি কার্যকলাপ থেকে শুরু করে বড় অঙ্কের কর ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রও ব্যবহার করা হতে পারে। তার উপর এত বেশি অঙ্কের মুদ্রা (ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেট ক্যাপ বর্তমানে ভারতীয় মুদ্রার হিসেবে প্রায় ১৪৯ লাখ কোটি টাকা) যখন দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকে, তখন সরকারের পক্ষে সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়নের সময়েও সমস্যায় পড়তে হয়ে থাকে। এদিকে ক্রিপ্টোর বাজার দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও দেশই এটিকে পুরোপুরি বন্ধ করতে চায় না। তাই, বৈধ বিকল্পের জন্য, ভারত সরকার মূলত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ইস্যু করে নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার পথে হাঁটছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকল্প হিসেবে সরকার স্বীকৃত এক ব্যবস্থা তৈরি হবে যার বৈধতা এবং আস্থা আরও বেশি গ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া, ব্যবহারকারীদের সুবিধার কথা বলতে গেলে, ডিজিটাল রুপি ব্যবহার করে লেনদেনগুলি অনেক বেশি নির্বিঘ্ন এবং কার্যকর হবে। তার উপর, এটি এমন একটি লেনদেনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং পেমেন্ট গেটওয়েগুলির মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময় অনেকটা কমিয়ে দেবে।
ভারত ২০১৯ সাল থেকে তার ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে চিন্তা শুরু করেছিল। এখনও পর্যন্ত, কিছু দেশ ইতিমধ্যেই তাদের ডিজিটাল কারেন্সি প্রোগ্রাম চালু করেছে। উদাহরণ হিসেবে চিন তার নিজস্ব ডিজিটাল ইউয়ান শুরু করেছে, এবং রাশিয়া তার ক্রিপ্টোরুবল মুদ্রার জন্য পরিকল্পনা করছে। ইউরোপীয় দেশগুরলির মধ্যে সুইডেন ইতিমধ্যে তার ই-ক্রোনা ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে এবং তার নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করার বিষয়ে সে দেশে বিতর্ক শুরু করেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, আরবিআই নিজে থেকেই ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করা হলে, ডিজিটাল রুপির মতো সিবিডিসিগুলি প্রথাগত ব্যাঙ্কগুলির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিতে পারে। মানুষ তখন তাদের অর্থ আর ব্যাঙ্কে নাও রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলির আমানত কমে যেতে পারে। এমন হলে, ব্যাঙ্কগুলির পক্ষে এমন বিভিন্ন ব্যবসাগুলিতে অর্থ ধার দেওয়ার কাজ আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনৈতিক গতিতে। তবে এই মুহূর্তে, আমাদের কাছে ডিজিটাল রুপি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই এবং আমাদের এর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
না, ভারতে ডিজিটাল রুপিতে ৩০ শতাংশ ক্রিপ্টো কর প্রযোজ্য হবে না। ৩০ শতাংশ কর প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম ইত্যাদির মতো প্রযোজ্য হবে।
যেহেতু ডিজিটাল রুপি ভারতে আরবিআই থেকে জারি করা হবে, তাই এটি ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এক্ষেত্রে আপনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর ভরসা রাখতে পারেন যে আমনার টাকা কোথায় নষ্ট হয়ে যাবে না। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আরবিআই তার ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে কী কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োগ করে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে আরবিআই “গুরুতর উদ্বেগ” প্রকাশ করে বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ করেছিল। তবে, ২০২০ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং বলে যে এটি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এখনও পর্যন্ত সরকারের যা দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ভারতে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হবে না। তবে ভারত সরকার একটি বিল নিয়ে কাজ করছে, যাতে প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির উপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আনা যায়।
বাংলা টেলিভিশনে প্রথমবার, দেখুন TV9 বাঙালিয়ানা
বাংলা টেলিভিশনে প্রথমবার, দেখুন TV9 বাঙালিয়ানা
নয়া দিল্লি: কেন্দ্র যে ডিজিটাল কারেন্সি (Digital Currency) আনতে চলেছে, তেমন ইঙ্গিত আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। সম্প্রতি ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের (Nirmala Sitharaman) কথায় তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। নির্মলার ঘোষণা, ‘ডিজিটাল রুপি’ (Digital Rupee) নামে এক ডিজিটাল মুদ্রা শীঘ্রই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (RBI) দ্বারা জারি করা হবে। ভারতে যখন প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ করা নিয়ে তুমুল জল্পনা ছড়িয়েছে, ঠিক সেই সময়েই এই ডিজিটাল মুদ্রার ঘোষণা বাজেটে। যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখনই কিছু করা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এই ক্রিপ্টোর ট্রেডিং এবং এনএফটির মতো ভার্চুয়াল ডিজিটাল সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ের উপর ৩০ শতাংশ কর চাপানো হবে। আপাতভাবে সরকারের যা দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত সরকার চায় মানুষ এই ক্রিপ্টোকারেন্সির বদলে স্বদেশি ডিজিটাল রুপি ব্যবহার করুক। তবে এই ডিজিটাল মুদ্রা বিষয়টি ঠিক কী? বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ডিজিটাল মুদ্রার কথা বলার পর থেকে অনেকের মনেই এই কথা শোনা যাচ্ছে। আর সবথেকে বেশি যেটা ভাবাচ্ছে তা হল ডিজিটাল রুপিও কি বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মতো একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি?
ডিজিটাল রুপি বুঝতে গেলে সবার আগে বুঝতে হবে সিবিডিসি বিষয়টি। সিবিডিসি কথাটির অর্থ হল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল মুদ্রা। এটি হল মূলত এক ধরনের ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মুদ্রা, যা সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে জারি করা হয়। যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হল আরবিআই। আর আরবিআইয়ের হাতে এমন একটি ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করার ক্ষমতা রয়েছে। এই মুদ্রা অনেকটাই কাগজের নোটের (ফিয়াট কারেন্সি) মতোই, তবে এটিকে আপনি হাতে গুণতে পারবেন না। এখন আরবিআই যখন ডিজিটাল রুপি চালু করার পথে এগোচ্ছে, তখন এটা স্পষ্ট যে এই ডিজিটাল রুপিটি হবে ভারতের সিবিডিসি এবং বর্তমান প্রচলিত মুদ্রার (ফিয়াট কারেন্সি) ডিজিটাল সংস্করণ হিসেবে বিবেচিত হবে। লেনদেনেও ব্যবহার করা যাবে। বাজেট পেশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে।
সম্ভবত, ২০২২-২৩ সালের মধ্যেই আইবিআইয়ের তরফে এক ডিজিটাল রুপি চালু করা হবে। এটি মূলত ভারতের সরকারি মুদ্রার এক ডিজিটাল টোকেন হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আরবিআই এই ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করবে ও যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করবে। ২০২২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেনে, ব্লক চেন এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলবে আরবিআইয়ের ডিজিটাল রুপি। তবে, আরবিআই কীভাবে ডিজিটাল রুপি বাস্তবায়ন করতে চলেছে এবং এটি কী ধরনের ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করতে চলেছে তা এখনও জানা যায়নি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই ডিজিটাল রুপি অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, ইত্যাদির সঙ্গে ইন্টার-অপারেবল হবে কিনা তাও স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি।
কেন্দ্রীয় বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী, ভারত সরকার ২০২২-২৩ সালের মধ্যে কোনও এক সময় ডিজিটাল রুপি প্রকাশ করতে চলেছে। উল্লেখ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এর আগে ২০১৯ সাল থেকে নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার কথা ভাবছিল। কিন্তু এখন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ হয়ে গিয়েছে। সব ঠিক থাকলে, এই বছর অথবা আগামী বছরের শুরুতেই এই ব্লক চেন ভিত্তিক ডিজিটাল রুপি আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
প্রথমত ডিজিটাল রুপি এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির মধ্যে এক মৌলিক ফারাক রয়েছে। তা হল – ডিজিটাল রুপি হল সেন্ট্রালাইজড এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মতো জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির ক্ষেত্রে কোনও সেন্ট্রালাইজড মডেল নেই। অর্থাৎ, এর উপর কোনও একক প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। আরবিআই ডিজিটাল রুপি ইস্যু করছে। তবে অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিতে এমন কোনও ইস্যু করার প্রতিষ্ঠান নেই।
আরও একটি বড় পার্থক্য হল যে ডিজিটাল রুপি অর্থের ট্রেইল তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, একটি লেনদেনের ক্ষেত্রে তার যাবতীয় তথ্য খুঁজে বের করতে পারে এই ডিজিটাল রুপি। কে অর্থ পাঠাচ্ছেন, কার কাছে পাঠাচ্ছেন – এই তথ্য হাতে আসার ফলে ডিজিটাল রুপির জন্য প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে। ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির ক্ষেত্রে কেবব এনক্রিপ্ট করা নম্বর এবং অক্ষরের দীর্ঘ স্ট্রিং পাওয়া যায়। আর এই পার্থক্যটাই ক্রিপ্টোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিজিটাল রুপিকে আলাদা করে তোলে। এখন দেখার বাজারে চলতি জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডিজিটাল রুপি কতটা জায়গা করে নিতে পারে!
ডিজিটাল রুপি এবং ডিজিটাল ক্যাশের মধ্যে প্রযুক্তিগত পার্থক্য রয়েছে। সম্প্রতি, এক বক্তৃতায়, আরবিআই-এর ডেপুটি গভর্নর টি রবি শঙ্কর, ডিজিটাল রুপি এবং ইউপিআই-এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে, “সিবিডিসি-র ক্ষেত্রে অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের তুলনায় কিছু সুস্পষ্ট সুবিধা রয়েছে। সিবিডিসি ব্যবহারে ঝুঁকি অনেকটা কম। এমন একটি ইউপিআই ব্যবস্থার কথা ভাবুন, যেখানে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের পরিবর্তে সিবিডিসির লেনদেন করা হয়। সেক্ষেত্রে দুটি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে আর্থিক নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয়তা থাকে না। সিবিডিসি ব্যবস্থা আর্থিক লেনদেনেরে ব্যবস্থাকে আরও রিয়েল-টাইম করে তুলবে।”
সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, “একজন ভারতীয় যখন কিছু আমদানি করছেন, তিনি আমেরিকান রফতানিকারককে কোনও মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন ছাড়াই ডিজিটাল ডলারে রিয়েল-টাইম লেনদেন করতে পারবেন৷ এই ক্ষেত্রে লেনদেনের জন্য মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের থেকে কোনওরকম নিষ্পত্তির প্রয়োজন থাকবে না। আর্থিক বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে টাইম জোনের পার্থক্য আর কোন ব্যাপার হবে না।”
ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির মতো এই নতুন ব্যবস্থাগুলিকে নিয়ে বিশ্বের তাবড় দেশগুলিও যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছে। কারণ, এই মুদ্রাকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা সেই লেনদেন কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে… কিছুই জানা সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার উদ্বিগ্ন যে, এই ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ, জঙ্গি কার্যকলাপ থেকে শুরু করে বড় অঙ্কের কর ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রও ব্যবহার করা হতে পারে। তার উপর এত বেশি অঙ্কের মুদ্রা (ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেট ক্যাপ বর্তমানে ভারতীয় মুদ্রার হিসেবে প্রায় ১৪৯ লাখ কোটি টাকা) যখন দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকে, তখন সরকারের পক্ষে সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়নের সময়েও সমস্যায় পড়তে হয়ে থাকে। এদিকে ক্রিপ্টোর বাজার দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও দেশই এটিকে পুরোপুরি বন্ধ করতে চায় না। তাই, বৈধ বিকল্পের জন্য, ভারত সরকার মূলত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ইস্যু করে নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার পথে হাঁটছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকল্প হিসেবে সরকার স্বীকৃত এক ব্যবস্থা তৈরি হবে যার বৈধতা এবং আস্থা আরও বেশি গ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া, ব্যবহারকারীদের সুবিধার কথা বলতে গেলে, ডিজিটাল রুপি ব্যবহার করে লেনদেনগুলি অনেক বেশি নির্বিঘ্ন এবং কার্যকর হবে। তার উপর, এটি এমন একটি লেনদেনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং পেমেন্ট গেটওয়েগুলির মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময় অনেকটা কমিয়ে দেবে।
ভারত ২০১৯ সাল থেকে তার ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে চিন্তা শুরু করেছিল। এখনও পর্যন্ত, কিছু দেশ ইতিমধ্যেই তাদের ডিজিটাল কারেন্সি প্রোগ্রাম চালু করেছে। উদাহরণ হিসেবে চিন তার নিজস্ব ডিজিটাল ইউয়ান শুরু করেছে, এবং রাশিয়া তার ক্রিপ্টোরুবল মুদ্রার জন্য পরিকল্পনা করছে। ইউরোপীয় দেশগুরলির মধ্যে সুইডেন ইতিমধ্যে তার ই-ক্রোনা ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে এবং তার নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করার বিষয়ে সে দেশে বিতর্ক শুরু করেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, আরবিআই নিজে থেকেই ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করা হলে, ডিজিটাল রুপির মতো সিবিডিসিগুলি প্রথাগত ব্যাঙ্কগুলির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিতে পারে। মানুষ তখন তাদের অর্থ আর ব্যাঙ্কে নাও রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলির আমানত কমে যেতে পারে। এমন হলে, ব্যাঙ্কগুলির পক্ষে এমন বিভিন্ন ব্যবসাগুলিতে অর্থ ধার দেওয়ার কাজ আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনৈতিক গতিতে। তবে এই মুহূর্তে, আমাদের কাছে ডিজিটাল রুপি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই এবং আমাদের এর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
না, ভারতে ডিজিটাল রুপিতে ৩০ শতাংশ ক্রিপ্টো কর প্রযোজ্য হবে না। ৩০ শতাংশ কর প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম ইত্যাদির মতো প্রযোজ্য হবে।
যেহেতু ডিজিটাল রুপি ভারতে আরবিআই থেকে জারি করা হবে, তাই এটি ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এক্ষেত্রে আপনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর ভরসা রাখতে পারেন যে আমনার টাকা কোথায় নষ্ট হয়ে যাবে না। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আরবিআই তার ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে কী কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োগ করে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে আরবিআই “গুরুতর উদ্বেগ” প্রকাশ করে বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ করেছিল। তবে, ২০২০ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং বলে যে এটি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এখনও পর্যন্ত সরকারের যা দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ভারতে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হবে না। তবে ভারত সরকার একটি বিল নিয়ে কাজ করছে, যাতে প্রাইভেট ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির উপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আনা যায়।