সু ম ন রা য়
ভারতীয় টেনিস জগতে এক বর্ণময় অধ্যায় লিখেছেন তিনি। বিশ্বের তাবড় তাবড় টেনিস তারকাকে হারিয়েছেন। তাঁর বর্ণময় কেরিয়ার ট্রফিতে ট্রফিতে সুসজ্জিত। আর এখন জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছেন ভারতের টেনিস তারকা লিয়েন্ডার পেস। নতুন এক লড়াই শুরু করেছেন তিনি। তবে এবার আর টেনিস লনে নয়। টেনিস পরবর্তী জীবনে রাজনীতিতে এ এক নতুন অধ্যায় রচনা শুরু করেছেন লিয়েন্ডার।
এক একান্ত সাক্ষাৎকারে লিয়েন্ডার গোয়াতে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের কারণ থেকে শুরু করে আগামী দিনে কী কী সমস্যা তৈরি হতে পারে, কীভাবে তিনি পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছেন, সেই সব নিয়ে কথা বলেছেন। সম্প্রতি গোয়ায় তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁকে প্রজেক্ট করা হতে পারে বলে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে। তবে লিয়েন্ডার জানালেন, সে সব জল্পনাকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইছেন না । আর কী কী বললেন ভারতের কিংবদন্তী টেনিস তারকা?
প্রশ্ন: কেরিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংস কীভাবে দেখছেন আপনি? খেলাধুলোর দুনিয়া থেকে এটা কতটা আলাদা এবং কতটা কঠিন?
লিয়েন্ডার: এই দ্বিতীয় ইনিংসটা পেয়ে আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করি। শুরুটা চমৎকার হয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের থেকে সাড়া পাচ্ছি, রাস্তায় বেরোচ্ছি, প্রচার চালাচ্ছি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, তাদের সঙ্গে বসে তাদের অভাব-অভিযোগ বোঝার চেষ্টা করছি, তাদের সমস্যাগুলি সমাধানের কথা ভাবছি – এটা একেবারে আমার নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে পারছি। আমি যে আবেগ পাচ্ছি এবং যে পরিমাণে আশীর্বাদ পাচ্ছি, তার সত্য়িই তুলনা হয় না। আমার রাজনীতিতে আসার কারণ হল, আমি চাই মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে। সেটাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আর এটাই আমার আবেগের জায়গা। আমি তৃণমূলকে এবং রাজনীতিতে আমার নেত্রী, আমার অনুপ্রেরণা মমতা দিদিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার ভাই-বোনদের জীবনকে আরও উন্নত করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন: আপনি কলকাতার মানুষ, কলকাতা তথা গোটা বাংলায় তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি, তাহলে কলকাতা ছেড়ে গোয়াকেই বেছে নিলেন কেন?
লিয়েন্ডার: আমি গোয়া বেছে নিয়েছি কারণ, এখানে আমার শিকড় জড়িয়ে রয়েছে। আমার বাবার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কলকাতা হোক বা গোয়া, আমি সবসময় ভারতের জাতীয় পতাকার হয়ে খেলেছি। তেরঙ্গা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তাতে বাংলা বা গোয়া বা পঞ্জাব বা তামিলনাড়ু… সেটা আমার কাছে আসলে বড় ব্যাপার নয়। দিনের শেষে, আমি সেখানে প্রত্যেক ভারতীয়ের জীবনকে আরও উন্নত করতে চাই। আমি মনে করি সুশাসন নিয়ে আসা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার সুযোগ এখনও রয়েছে। আন্তরিকভাবে সুশাসনের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের সমস্যাগুলি দেখা এবং তার সমাধান করা, একটি নিয়মমাফিক পরিকল্পনা করা এবং সেই নিয়মমাফিক উপায়ে নাগরিকদের জীবনে পরিবর্তন আনার সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন : অন্য রাজনৈতিক দলগুলি থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল? তৃণমূলই কেন?
লিয়েন্ডার: হ্যাঁ, আমি গত ১৮ বছর ধরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির থেকে অফার পেয়েছি। কিন্তু আমি টেনিসের প্রতিই মনোযোগ রাখতে চেয়েছিলাম তখন। আমি যে কোনও কাজ নিখুঁতভাবে করতে পছন্দ করি এবং আমি যা করতে পারি তা করতে চাই। এর আগে যখনই অফার এসেছে তখন সঠিক সময় বা সঠিক অফার ছিল না। আমার হাতে বেশি সময় ছিল না। আমি উইম্বলডন জেতার উপর মনোনিবেশ করছিলাম। ডেভিস কাপে বিশ্ব রেকর্ড এবং অলিম্পিকে ভারতের হয়ে বিশ্ব রেকর্ড করার জন্য জোর দিয়েছিলাম। কিন্তু এই সময় মমতাদি এবং তৃণমূল আমাকে গোয়ায় আসার প্রস্তাব দেন। এই গোয়ায় আমার পৈতৃক শিকড় জড়িয়ে রয়েছে।
আমি এখন গোয়ার উপর পুরোপুরি মনোনিবেশ করছি। তারপরে বাকি ভারতের নাগরিকদের জন্যও কাজ করতে চাই। আমি মনে করি আমার জীবনের হিসেবে এটাই সঠিক সময় ছিল। এটাই ছিল সঠিক পথ এবং সঠিক সুযোগ। আমি কৃতজ্ঞ যে আমার দ্বিতীয় ইনিংসটি দুর্দান্ত শুরু হয়েছে। আমার সামনে এখন দীর্ঘ পথ চলা বাকি আছে এবং সামনের রাস্তা অনেক কঠিন। এটা সবে শুরু। আমি যেভাবে ৩০ বছর ধরে টেনিস খেলেছি, ঠিক সেভাবেই আমি মানুষের সেবা করতে চাই এবং তাদের জীবন উন্নত করতে চাই। সেই মতে এক এক করে এগোতে চাই।
গত ৫-৬ সপ্তাহে আমার জ্ঞান অনেকটা বেড়েছে। শুধু সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়েই নয়, মানুষের জীবনযাত্রার মানকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সেই বিষয়েও অনেক কিছু জানছি। গোয়াতে, আমাদের কাছে দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। এটা সত্যিই ভারতের অন্যতম জৌলুসে ভরা রাজ্য হতে পারে। এখানকার জনসংখ্যা মাত্র ১৫.৯ লাখ। তাঁদের মধ্যে ৯ লাখ স্থানীয় এবং বাকিরা অন্যান্য জায়গা থেকে আসা অভিবাসী। যদি এখানে শাসন ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল থাকে, তবে গোয়ার উন্নয়নের দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। সেটাই করতে চায় তৃণমূল। এখানে যা কিছু ভুল কাজ হয়েছে, তার একটি চার্জশিট আমাদের কাছে রয়েছে। কীভাবে তা সংশোধন করা যেতে পারে, তা নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গোয়ার সম্পদ – তা খনি হোক বা মাছ ধরা হোক। রাজ্য হিসাবে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটি সুশাসনের সরকারের হাত ধরে ভারত বিশ্বের এক শক্তিধর দেশ হিসেবে উঠে আসতে পারে।
প্রশ্ন: গোয়ায় ভোট এগিয়ে আসছে, আপনারা কী কী ইস্যুকে হাতিয়ার করতে চাইছেন?
লিয়েন্ডার: গোয়ায় যে ইস্যুগুলি রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল পোর্টেবল পানীয় জল। ১২ টি তালুকের মধ্যে ৬ টিতে পোর্টেবল পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। এটাই আমাদের করা উচিত। বৃষ্টির জল সংরক্ষণ খুবই ভাল উপায় যা আমাদের পূর্বপুরুষরা এককালে করতেন। অতীতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হত। কিন্তু এখন তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কারণ, তারা এখন জল সংরক্ষণের বদলে টাকা কামানোর জন্য তাদের জমি বিক্রি করছে। গোয়ায় আসা সমস্ত অভিবাসীদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নারীদের নিরাপত্তা একটি গুরুতর সমস্যা। দেখুন, তৃণমূল কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে। গোয়ায় মহিলাদের নিরাপত্তা একটি বড় সমস্যা। মহিলাদের নিরাপত্তায় বাংলা দেশের মধ্যে এক নম্বর রাজ্য।
খনি সংক্রান্ত সমস্যাও রয়েছে। খনিতে যে সম্পদ সৃষ্টি হয় তা আমাদের সমাজে ফিরে আসছে না। তরুণদের জন্য চাকরির সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার সমস্যা আছে। আপনি যখন গোয়াকে সামগ্রিকভাবে দেখবেন, এখানকার যুব সম্প্রদায়ের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন করা দরকার, যাতে তাঁরা ভাল চাকরি পান।
সমস্যা রয়েছে মৎসজীবীদেরও। শাসনব্যবস্থায় বড় সমস্যা রয়েছে। আমার গ্রাম মৎসজীবীদের গ্রাম। মৎসজীবীদের কথা বলতে গেলে, আমি বিশ্বাস করি গোয়াতে রেজিস্টার হওয়া নৌকাগুলিতে অন্য জায়গা থেকে আসা নৌকার তুলনায় ভাল মাছ ধরা হয়। অন্যান্য রাজ্যের মাছ ধরার নৌকা আমাদের গোয়ায় আসার ফলে, এখানকার স্থানীয় মৎসজীবীদের রুজি রুটিতে টান পড়ছে। তাই আমাদের গোয়ার মৎসজীবীদের কথা ভাবা খুবই জরুরি।
গোয়ায় পর্যটনের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। নিরাপত্তাও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। গোয়ার জীবনযাত্রার মান খুব ভাল। পাহাড়, সমুদ্র বা শহর… সবকিছু এখানে আছে। আমি মনে করি গোয়াকে পৃথিবীর এক নম্বর পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করা যেতে পারে।
গোয়া তথা গোটা ভারতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে খেলাধুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। খেলাধুলায় আমাদের প্রায় তিন কোটি কাজের সুযোগ রয়েছে এবং আমি এর একটি অংশ হতে পেরে গর্বিত। আমরা আরও ব্যাপক আকারে গোয়ায় খনি পুনরায় শুরু করতে চাই এবং এটি নিশ্চিত করতে চাই যে সেই সম্পদের একটি বড় অংশ আমাদের যুবকদের জন্য চাকরি তৈরি করতে এবং গোয়ার ঋণ পরিশোধ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রশ্ন: গোয়ায় তৃণমূল আপনাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
লিয়েন্ডার: আমি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার বিষয়ে কিছু ভাবছি না। আমি সবেমাত্র আমার ইনিংস শুরু করেছি। আমি প্রতিদিন নিজেকে বিকশিত করব। আমি শুধু চাই সুশাসন আসুক। সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন ও আরও উন্নত করতে আমি লড়াইয়ে আছি। তাই পথ আমাকে যেখানেই নিয়ে যাবে, আমি আমার পথে আসা সুযোগগুলি অবশ্যই কাজে লাগাব। আমার কঠোর পরিশ্রম, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এবং আবেগকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাব। একইসঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের কী কী সমস্যা রয়েছে, সেগুলির প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করব।
যদি আমার কাছে সুযোগ আসে, আমি তা অত্যন্ত সততার সঙ্গে এবং আন্তরিকভাবে দেখব। গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথা ভাবছি না। গোয়ার জনগণের জন্য ভাল কাজ করা, মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করা, তাদের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য রাজনীতিতে আসা। সেই একই আবেগ ও পরিশ্রম, দেশপ্রেম নিয়ে মানুষের জীবন আরও উন্নত করার জন্য চেষ্টা করব। এটা আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে। আমি সাধ্যমত মানুষের সেবা করতে চাই।