শিলিগুড়ি: পুরভোটে শিলিগুড়িতে কার্যত সবুজ ঝড়। খুঁজেই পাওয়া যায়নি বাম (CPIM) ও পদ্ম শিবিরকে (BJP)। সবুজ ঝড়ে দীর্ঘ দিনের লাল দূর্গ শিলিগুড়ি পুরনিগমও তৃণমূলের দখলে চলে এসেছে। রাজ্যে গত বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য শিলিগুড়ি পুরসভায় বিজেপি-র প্রভাব দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পুরনির্বাচনে ৪৭ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে গত ২৭ বছরে এই প্রথম বার পুর বোর্ড গঠন করতে চলেছে তৃণমূল। ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে শিলিগুড়ি পুরনিগমের ৩৭টি ওয়ার্ডে জয়লাভ করেছে রাজ্যের শাসক দল। পাঁচটি ওয়ার্ডে জিতেছে বিজেপি এবং তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা বামেদের দখলে রইল মাত্র চারটি ওয়ার্ড। আর কংগ্রেসের দখলে একটি। কেন এমন হার? আত্মসমীক্ষায় নেমেছে বাম-বিজেপি।
সাংগঠনিক দুর্বলতার জেরেই হার, প্রাথমিকভাবে এমনটাই মনে করছে বাম-বিজেপি। অন্যদিকে বামের যে ভোট রামে গিয়েছিল সেই ভোট আর বামের ঘরে ফিরল কই? ফেল করল অশোক মডেল। ঠিক এই দুই কারণ এর জেরেই শিলিগুড়িতে কার্যত পতন পদ্ম ও কাস্তে-হাতুড়ির। গত বিধানসভা নির্বাচনে যে শংকর ঘোষ ছিলেন যুব সমাজের আইকন। সেই বিধায়ককে কার্যত নিজের ওয়ার্ডে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যেতে হল। আনকোড়া প্রার্থীর কাছে হারলেন অশোক ভাট্টাচার্যও।
বিজেপির অন্দরমহল সূত্রে খবর, সরাসরি না হলেও দলের কর্মীরাও এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। বুথস্তরে সংগঠন না থাকা, লোকসভা ও বিধানসভায় নিজেদের দখলে আসা ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে না পারায় ভরাডুবি হয়েছে। নতুন কোনও প্রস্তাবও সেভাবে বিজেপি সাধারণ মানুষের সামনে আনতে পারেনি। ফলে , খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
বিধায়ক শংকর ঘোষের দাবি, “বিজেপি আগে ছিল লোকসভা ভিত্তিক দল। পরে আমরা রাজ্যে নিজেদের প্রসার বাড়াতে শুরু করি। কিন্তু স্থানীয় স্তরে এখনো সংগঠন নেই। বুথকর্মী নেই, বুথকমিটিও নেই। পাশাপাশি নেই বিজেপির পালের হাওয়া। শুধুমাত্র বিশ্বাস ছিল মানুষ ভোট দেবে। লড়াই করেছি। এই হার থেকেই শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে।”
অন্যদিকে, বামেদের দাবি, গত ছয়মাসে দলের বহু কাউন্সিলর, ডেপুটি মেয়র, মেয়র পারিষদের দলত্যাগ আদতে দলের ছবিটা খুব ভাল তৈরি করেনি। যত দিন গিয়েছে, সংগঠন দূর্বল হয়েছে। কোনও বিকল্প প্রস্তুত করতে অক্ষম ছিল বাম শিবির। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো সম্ভব আদপেই হয়নি বলেই মনে করছেন দলের অন্দরের অনেকেই।
বামের মুখ অশোক ভট্টাচার্য আনকোড়া তৃণমূল প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। অশোক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “ধর্মীয় মেরুকরণ করেই সংখ্যালঘু ওয়ার্ডে জিতেছে তৃণমূল। আমাদের যে ভোট বিধানসভায় গিয়েছিল তা ফিরে আসেনি।” পাশাপাশি তিনি বলেন, “গত কয়েক মাসে ডেপুটি মেয়র-সহ একাধিক মেয়র পারিষদ, কাউন্সিলরেরা দল ছেড়ে চলে যান। আমরা মুখে বলেছিলাম ক্ষতি হবে না। কিন্তু বাস্তবে সংগঠন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। যার জেরে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মুখ থুবড়ে পরেছি আমরা।”
গত বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে এই পুরভোটে শিলিগুড়িতে বিজেপি-র ভোট শতাংশ অনেক কমেছে। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের ‘আশঙ্কা’ অন্য। বিধানসভা নির্বাচনের সময় সিপিএম থেকে বিজেপি-তে যাওয়া শঙ্কর ঘোষের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড পরাজিত হয়েছেন। নিজের পাড়াতেই বিধায়কের এই পরাজয় কার্যত গেরুয়া শিবিরের চিন্তা বাড়িয়েছে। কারণ, শঙ্করের দলবদল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের যদিও দাবি, গত লোকসভা এবং বিধানসভায় বিজেপি-তে যাওয়া বামেদের ভোটব্যাঙ্ক এ বার তৃণমূলের ঘরে এসেছে।
২০১৫-য় শিলিগুড়িতে পুরসভা ভোটে অশোকের মস্তিষ্কপ্রসূত শিলিগুড়ি মডেল ছিল অন্যতম আলোচনার বস্তু। সেই মডেলও কার্যত ডাঁহা ফেল! প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থন ও পরে নির্দলের সমর্থনে সে বার শিলিগুড়িতে পুরবোর্ড গড়েছিলেন অশোক। সেই বোর্ডের মেয়াদ টিকেও যায়। এ বার প্রথম শিলিগুড়িতে তৃণমূল বোর্ড গঠন করেছে।
অন্য দিকে, শিলিগুড়িতে তৃণমূলের বিপুল জয়ের জন্য বামেদেরই দায়ী করেছেন কংগ্রেস নেতা শঙ্কর মালাকার। তিনি বলেন, ‘‘বামফ্রন্টের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অশোক ভট্টাচার্যের অহঙ্কারই ডুবিয়েছে। বার বার জোটের কথা বলেও তারা আগেভাগে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে সেই সম্ভাবনায় জল ঢেলেছে। জোট বেঁধে কংগ্রেস-বাম লড়াই করলে ভোটারদের আস্থার অর্জন করতে পারা যেত।’’ আপাতত, এই পরাজয় কাটিয়ে উঠে নতুন কোনও দিশা দেখাতে পারে কি না বাম ও রাম শিবির সেদিকেই তাকিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল।
আরও পড়ুন: Dilip Ghosh On Suvendu Adhikari: ‘শুভেন্দুর মেজাজ হারানো স্বাভাবিক, ওতে আমি কিছু মনে করি না’