কল্যাণপুর: তিপ্রাসা’দের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবিতে শেষ লড়াইয়ে রাজকুমার। ২০২৩ সালের ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে তৈরি হয়েছে এমনই এক ছবি। যেন ফিরে এসেছে ৭৫ বছর আগের রাজতন্ত্র। লাল-হলুদ রঙের পোশাকে উজ্জ্বল তিপ্রা মোথা দলের কর্মী-সমর্থকদের স্বতঃস্ফূর্ত ‘বুবাগ্রা’ (রাজা) ধ্বনির মধ্যে কালো কুর্তায় রাজার মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছেন ত্রিপুরা রাজবংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্য দেববর্মন। তাঁকে কেন্দ্র করেই ফের পৃথক গ্রেটার ত্রিপুরা রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখছে ত্রিপুরি উপজাতি। প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্য দেববর্মনও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, “আমাদের পৃথক তিপ্রাসা রাজ্যের দাবি যে সরকার মানবে না, তাদের সঙ্গে কখনই আমরা জোট গড়ব না।”
১৯৪৭ সালের আগে কয়েক শতাব্দী ধরে ছোট্ট ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতা ছিল প্রদ্যোৎ মাণিক্যের পূর্বপুরুষদের হাতে। ভারতের স্বাধীনতার সময়, ত্রিপুরার রাজ পরিবার তাঁদের রাজ্যকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। প্রদ্যোতের বাবা-মা কিরিৎ বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মন এবং বিভু দেবী – দুজনেই কংগ্রেসের সাংসদ ছিলেন। কিন্তু, তারপর থেকে খোয়াই নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। গত কয়েক দশকে পৃথক তিপ্রাসা রাজ্যের দাবিতে বারে-বারে অশান্ত হয়েছে আপাত শান্ত ত্রিপুরা রাজ্য। গত শতাব্দীর আটের দশকে প্রথম পৃথক ত্রিপ্রাসা রাজ্যের দাবি তোলে ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স। সেই যাত্রা ত্রিপুরা রাজ্যের একটা বড় অংশে উপজাতিদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দিয়ে অশান্তি সামাল দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। কিন্তু, ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ত্রিপুরা সাক্ষী হয়েছে নজিরবিহীন সন্ত্রাসের। বিশেষ করে ১৯৯৬-এর ১২ ডিসেম্বর অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের হাতে ২৭ জন বাঙালির নিধন, কাঁপিয়ে দিয়েছিল উত্তর পূর্বের এই রাজ্যকে।
এবার খোদ রাজ পরিবারকে কেন্দ্র করেই ফের একবার পৃথক তিপ্রাসা রাজ্য গঠনের স্বপ্নে বিভোর উপজাতি সম্প্রদায়। প্রদ্যোৎ মাণিক্যের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে পৃথক তিপ্রাসা রাজ্যের দাবিতে সরব বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিও। ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্সের প্রাক্তন প্রধান বিজয় কুমার হ্র্যাংখোয়াল, অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের প্রাক্তন প্রধান রঞ্জিত দেববর্মা – সকলেই এখন ‘বুবাগ্রা’র দলে। তবে, এর আগে যেভাবে উপজাতি বনাম বাঙালি, মণিপুরী বা মুসলিমদের সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে ত্রিপুরা, তা আর হতে দিতে চান না বলে স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রদ্যোৎ মাণিক্য। বিভিন্ন জনসভায় তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, “তিপ্রাসা এবং বাঙালিদের মধ্যে লড়াই চায় বিজেপি। ওরা উন্নয়নের কথা, প্রগতির কথা বলতে চায় না। আমরা সকলের উন্নয়ন চাই।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক স্বার্থেই এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলতে হচ্ছে প্রদ্যোৎ মাণিক্যকে। সমতল ত্রিপুরার বহু বাঙালিই এখনও ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স ও অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের সন্ত্রাসবাদকে ভুলতে পারেনি। ত্রিপুরার জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের মধ্যে ত্রিপুরিরা যেমন আছে, তেমনই আছে রেয়াং, জামতিয়া, চাকমা, মগ, কুকি, ব্রু, হালম, ভুটিয়া, খাসি এবং গারোরা। উপজাতিদের মধ্যে ত্রিপুরিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পূর্ববর্তী ত্রিপুরা রাজপরিবারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু, ত্রিপুরার সামগ্রিক জনসংখ্যার অধিকাংশই বাঙালি। তাদের মধ্যে অনেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ত্রিপুরার বাসিন্দা, বাকিদের কেউ কেউ এসেছেন বাংলাদেশের কুমিল্লা বা সিলেট থেকে। নয়া তিপ্রাসা রাজ্য শুধু উপজাতিদের নয়, বাঙালি, মণিপুরি, মুসলিমরাও এই রাজ্যের অংশ হবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রদ্যোৎ মাণিক্য।