কলকাতা: পঞ্চায়েতের মনোনয়নের (Nomination of Panchayat) শুরু থেকেই অশান্তি, মারপিট, খুনোখুনির অভিযোগ। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের পালা। তপ্ত রাজ্য রাজনীতির ময়দান। আর এসবের মধ্যেই বড় নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়াতেও সিবিআই তদন্তের (CBI Probe) নির্দেশ। এটাই হয়ত দেখা বাকি ছিল বঙ্গবাসীর। উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের বিডিও-র বিরুদ্ধে নির্বাচনী নথি বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে। আর সেই ঘটনা খতিয়ে দেখতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অমৃতা সিনহা। ৭ জুলাই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে রিপোর্ট জমার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। অর্থাৎ, ভোটের ঠিক একদিন আগে।
পঞ্চায়েতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পর বঙ্গ রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। বিগত দিনগুলিতে রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে শুরু করে একাধিক ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে আদালতকে। কিন্তু এবার নির্বাচনের কাজেও সিবিআই তদন্ত। এই নিয়ে বিরোধীরা ইতিমধ্যেই বিঁধতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। হাইকোর্টের নির্দেশে গোটা দেশের কাছে ‘বাংলার মুখ পুড়েছে’ বলে মনে করছে পদ্ম শিবির। পঞ্চায়েত ভোটেও সিবিআই তদন্ত রাজ্যের জন্য ‘লজ্জার’ বলে মনে করছে তারা। এ তো গেল বিরোধীদের কথা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশও হাইকোর্টের এমন নির্দেশকে কার্যত নজিরবিহীন বলেই ব্যাখ্যা করছেন।
বঙ্গ বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য হাইকোর্টের নির্দেশের পর একহাত নিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে। বাংলার প্রান্তিক মানুষের বিরুদ্ধে তিনি ‘যুদ্ধঘোষণা’ করেছেন বলে মনে করছেন শমীক। বললেন, ‘সিবিআই তদন্ত হচ্ছে, এটা লজ্জার। এই রায়ে নিঃসন্দেহে গোটা দেশের কাছে বাংলার মুখ পুড়ল।’
উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের বিডিও-র বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসন ও কমিশনকে খোঁচা দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীও। তাঁর কথায়, ‘মনোনয়ন প্রত্যাহারের সার্জারি’ চলছে বিডিও অফিসগুলিতে। কেমন সেই সার্জারি? অধীরের ব্যাখ্যা, প্রার্থীদের অগোচরেই নাকি মনোনয়ন প্রত্যাহার হয়ে যাচ্ছে। আর শাসক শিবির বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাচ্ছে। সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘এ এক অদ্ভুত সার্জারি চলছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে এমন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কার্যত নজিরবিহীন। তাঁর ব্যাখ্যা, হাইকোর্টের এই নির্দেশের ফলে প্রশাসনের উপর হাইকোর্টের ‘অনাস্থা’ ফুটে উঠেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিবিআই তদন্তের এমন নির্দেশ গোটা ভারতে আর কোথাও নেই বলেই জানাচ্ছেন তিনি।
বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘বিভিন্ন ইস্যুতে কলকাতা হাইকোর্টের রাজ্য প্রশাসনের উপর অনাস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এই রায় তারই একটি প্রতিফলন। এর আগে দুর্নীতি থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে একের পর এক সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে। এবার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সিবিআই তদন্তের আদেশ। এমন ঘটনা ভারতে প্রথম হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে পারছে না আদালত।’
পাশাপাশি এই রায়ের মাধ্যমে ‘প্রশাসনের দলীয়করণের’ একটি প্রতিফলন ফুটে উঠেছে বলেই মত তাঁর। বললেন, ‘প্রশাসনের যে বড় ধরনের দলীয়করণ হয়েছে, প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে যে তফাৎ থাকার কথা, তা রাখা যাচ্ছে না, সেটির একটি স্পষ্ট প্রতিফলন রায়ের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়েছে। প্রশাসনের দলীয়করণ কোন মাত্রায় গিয়েছে তা আরও স্পষ্ট হল এই রায়ের মাধ্যমে। বাধ্য হয়ে কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য প্রশাসনকে এড়িয়ে গিয়ে সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে।’
বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ অবশ্য হাইকোর্টের এই নির্দেশের ফলে বিশেষ কোনও সুরাহা হবে না বলেই মনে করছেন। বললেন, ‘সিবিআই তদন্ত করে কী করবে? তদন্ত করে তো নিম্ন আদালতেই যেতে হবে।’ একই সঙ্গে বাংলায় সিবিআই তদন্তের সাফল্য কতটা রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, ‘ক’টা সিবিআই তদন্ত সফল হয়েছে? পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে একটাও সিবিআই তদন্ত সফল হয়নি। ১০০ টা মামলার মধ্যে ৯৭টি ব্যর্থ হয়।’
পঞ্চায়েত ভোটের প্রক্রিয়ায় সিবিআই তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। বললেন, ‘পঞ্চায়েত ভোটেও সিবিআই আনতে হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটা ন্যায়বিচার হচ্ছে না।’ একইসঙ্গে সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘আদালত আমাদের কাছে একটি পবিত্র জায়গা। বিচারপতি অমৃতা সিনহা একজন শ্রদ্ধেয় বিচারপতি। কিন্তু কোন সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে দায়িত্ব? শুভেন্দু অধিকারীর নাম সিবিআইয়ের এফআইআর-এ আছে। তিনি বিজেপিতে আছেন বলে, সিবিআই তাঁকে ধরে না। সেই সিবিআইকে নিরপেক্ষ বলা হচ্ছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে রাজ্যকে দিয়ে তদন্ত করানো যেত। কেন সিবিআই?’