Exclusive Open Letter: প্রণামে নয়, উষ্ণতায় বিশ্বাস করতেন সৌমিত্রদা: অপুর জন্মদিনে তাঁর উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখলেন দেবশঙ্কর হালদার
কাছের মানুষের কাছে এই ধরনের দিন বিষণ্ণতা নিয়ে আসে। মানুষ বেশি মিস করতে শুরু করেন তাঁর প্রিয়জনকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তেমনই এক কাছের মানুষ। যিনি প্রণামে নয়, উষ্ণতায় বিশ্বাস করতেন। তেমনই জানিয়েছেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। একসঙ্গে কম কাজ তো করেননি। আজ (১৯.০১.২০২২) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে TV9 বাংলার জন্য কলম ধরলেন দেবশঙ্কর হালদার। 'প্রিয় সৌমিত্রদা'কে লিখলেন খোলা চিঠি।
(সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে লেখা দেবশঙ্কর হালদারের খোলা চিঠি। TV9 বাংলা এক্সক্লুসিভভাবে প্রকাশ করল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে।)
আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব সৌমিত্রদা, একটু বলে দিন। এই যে ‘সৌমিত্রদা’ বললাম… তার আগে তো চিঠিতে কিছু একটা লিখতে হয়। যেমন ধরুন ‘শ্রদ্ধেয় সৌমিত্রদা’, ‘সুজনবরেষু সৌমিত্রদা’, ‘সুহৃদ সৌমিত্রদা’, ‘প্রণম্য সৌমিত্রদা’, ‘অভিভাবক সৌমিত্রদা’, ‘বন্ধুবরেষু সৌমিত্রদা’, ‘প্রিয় সৌমিত্রদা’… এখন কোন শব্দটা আপনার পছন্দ হবে আমি ঠিক জানি না। আমার মনে হয় আপনার কোনও শব্দই পছন্দ হবে না। আমি একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছি। চিঠিটা শুরু করব কোত্থেকে বুঝতে পারছি না। মানে, কোন শব্দ দিয়ে চিঠিটা শুরু করব। নাকি কিছুই সম্বোধন থাকবে না, থাকবে কেবল ‘সৌমিত্রদা’।
আপনি বলবেন, ‘চিঠি তো লিখছ তুমি, আমাকে এই সব জিজ্ঞেস করছ কেন?’ এবার কথা হচ্ছে, চিঠি তো আমি লিখব, পড়বেন আপনি। ফলে এই চিঠি আর আমার একার থাকবে না। বেশিরভাগ সময়তেই হয়ে যাবে আপনার চিঠি। তার কারণ, আপনি কী ভালবাসেন, আপনি কী চান এবং কোন শব্দটা দিয়ে আপনাকে প্রণাম করা যায় অথবা আপনার খুব নিকটে যাওয়া যায়, কোন শব্দকে আশ্রয় করে… সেটা কেবল আপনি জানেন। আমরা কেবলই খুঁজে চলেছি।
আপনি এখন একটু দূরের বাড়িতে আছেন। আর অদ্ভুতভাবে সেই বাড়ির ঠিকানা আমাদের কাছে আড়াল করেছেন। সেই বাড়ি খুব সুন্দর বাড়ি। আবরণহীন, উপকরণহীন… অথচ পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ সেই বাড়িতে আছে.. আমি নিশ্চিতভাবে জানি। সেই বাড়ির ঠিকানা আপনি কাউকেই দেননি। কেবল নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছেন। তবে আজ এই চিঠি লেখার জোর মনের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছেন। আজকেই! বিশেষ করে আজ যখন আপনার জন্মদিন।
একটি কবিতার কথা খুব মনে পড়ছে আজ। শুনেছিলাম। মন খারাপ করা হওয়া যখন এই শীতকালে বইছে, তাকে মন খারাপ করা বলছি বটে, কিন্তু মন ভালও করে দিচ্ছে কখনও-কখনও। দেখেছেন সৌমিত্রদা, আজ ১৯ জানুয়ারিতে কেমন মিষ্টি মধুর রোদ্দুর উঠেছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় সেই কবিতাটি বলছি… ‘মন- ভালো -করা রোদ্দুর কেন মাছরাঙাটির গায়ের মতন? হ্রস্ব দীর্ঘ নীল নীলান্ত কেন ওর রং খর ও শান্ত, লাল হরিদ্রা সবুজাভ বন? মন-ভালো-করা রোদ্দুর কেন মাছরাঙাটির গায়ের মতন? মাছরাঙাটির গায়ে আলো পড়ে হাওয়ায়-বাতাসে পাতারাও নড়ে, মাছরাঙাটির গায়ে হাওয়া পড়ে, মন-ভালো-করা রোদ্দুর কেন মাছরাঙাটির গায়ের মতন।।’
এরকম একটা মন ভাল করা রোদ্দুর যখন আপনার জন্মদিনে উঠেছে… আমি জানি আপনি সেই রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে আপনার সেই অসম্ভব সুন্দর আবরণহীন, উপকরণহীন বাড়িতে একটি ছবি আঁকছেন। কিংবা কবিতা লিখছেন। যদিও মনের ভিতরে আপনার কিছু সংলাপ এসে উঁকি দিচ্ছে…
…কেননা আজ যে ১৯ জানুয়ারি। এই দিনে আমরা সাধারণভাবে অভিনয় করে থাকি। যে অভিনয়ে আপনি থাকেন। আমারও সৌভাগ্য হয় থাকার। কখনও কখনও আপনি অভিনয় করেন। আমি দর্শক আসনে বসে দেখি। কখনও আপনার সঙ্গেই অভিনয় করি। যদিও বা আমার জন্য বরাদ্দ নেই কোনও চরিত্র, তবুও আমিও চরিত্র হয়ে উঠি। কখনও আপনার চরিত্র হয়ে উঠি। কখনও আপনার উলটোদিকের চরিত্র হয়ে উঠি। যে সংলাপগুলি আপনি বলেন, সেইগুলি মনে হয় যেন আমিই বলছি। এইরকম একটা ১৯ জানুয়ারি আজ।
আজ বারবারই মনে হচ্ছে আপনার মনের ভিতরে কিছু সংলাপ এসে উঁকি দিচ্ছে। আপনাকে তাতাচ্ছে আর বলছে, ‘ওহে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যাবেলায় আপনার একটি অভিনয় আছে, আপনার এই আঁকাটি শেষ করে নিন। অথবা এই লেখাটি শেষ করে নিন। প্রস্তুত হন।’
আমি জানি আপনি লিখছেন। আঁকছেন। আঁকিবুকি কাটছেন। মনের ভিতর মক শো করছেন। এগুলো সব সত্য। এবং তার চেয়েও বেশি সত্য আপনার মনের মধ্যে সংলাপ এসে উঁকি দিচ্ছে। একাধিক সংলাপ। যে সংলাপ আপনি সন্ধ্যাবেলা আওড়াবেন। তার মধ্যেও একটি-দুটি সংলাপ আপনাকে তাড়া করছে।
কেন তাড়া করছে? কেননা ‘তাড়া’ আপনাকে ছাড়েনি কোনওদিন। আর আপনিও তাঁদের ছাড়েননি কোনওদিন। যবে থেকে আপনি সবরকম মানুষের সঙ্গে দেওয়ানেওয়া শুরু করেছেন, তবে থেকে আপনি সংলাপ শুরু করেছেন। সংলাপ! কখনও নীরব, কখনও বাঙ্ময়। চুপ করে তাকিয়ে থেকেছেন। কখনও বা চোখের আড়ে আপনি কথা বলেছেন। আপনার হাসিতে আপনি কথা বলেছেন। এবং এইভাবে ১৯ জানুয়ারি একটি অভিনয় নির্দিষ্ট হয়ে থেকেছে। আমরা একসঙ্গে অভিনয় করছি।
আমরা আজও একটি অভিনয় করব। আমি আজ আপনার গল্ফগ্রিনের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছব সৌমিত্রদা। এই ভাবনা আমার আছে। এবং সন্ধ্যায় আমি যাবই। সেখানে আপনি থাকবেন আমি জানি। আজও কিছু কিছু সংলাপ আদানপ্রদান করব আমরা। সেই নাটকের দর্শক থাকবেন আপনি। সেই নাটকের দর্শক থাকব আমি। সেই নাটকে অভিনেতা থাকবেন আপনি। সেই নাটকে অভিনেতা হব আমি।
…সেই নাটকের শেষে আপনার গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দেব আমি। আপনার পায়ের কাছে ফুল রাখব আমি। আর আপনি সেই পায়ের কাছে রাখা ফুলটি তুলে বলবেন, ‘এটা তুমি দু’হাতে ধরো’। আপনার গলার উত্তরীয়টি তুলে নিয়ে আমার কাঁধে পরিয়ে দিয়ে বলবেন, ‘আজকের দিনে এই উপহার আমি তোমাকে দিলাম’। এই কথা কেউ জানবে না। আপনি জানবেন। আমি জানব। তারপর আমি আপনার বাড়ি থেকে ফিরে আসব। আর আপনি আপনার গল্ফফ্রিনের বাড়ি থেকে পাড়ি দেবেন আপনার নতুন বাড়িতে। যে বাড়ির ঠিকানা আপনি আমাদের কাউকে দিলেন না। কেবল আড়ালে থেকে মুগ্ধতা তৈরি করলেন মাত্র।
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনার সেই নতুন বাড়িতে লম্বা লম্বা পদক্ষেপে পায়চারি করতে করতে বিরাট একটি নাটকের মক শো দিচ্ছেন আপনি। সেই কারণেই আপনার ওই বাড়িটা দরকার। কিং লিয়ারের মতো, রাজা লিয়ারের মতো একটি রাজার পাঠে আপনি মগ্ন হয়ে থাকবেন। আজ-কাল-পরশু। দিন পেরবে। আপনার বাড়ির চারপাশে, উত্তরে-দক্ষিণে-পূর্বে-পশ্চিমে আমরা নানাবিধ প্রদক্ষিণ করব। আর আপনি আপনার নতুন বাড়িতে বসে প্রস্তুত হয়ে যাবেন অন্য এক নাটকের জন্য।
…হয়তো আগামী ১৯ জানুয়ারিতে সেই নাটকের একটি অমোঘ সংলাপ দিয়ে আমাদের চমকে দেবেন। আমরা হাততালি দেব। আপনার হাতে, আপনার পায়ের কাছে একটি ফুলের স্তবক রাখব। আপনার কাঁধে একটি রঙিন শাল জড়িয়ে দেব। তারপর আমি জানি…
…আপনার পায়ের কাছের ফুলটি আপনি আবারও তুলবেন। আমাদের মতো অনুজ নাট্যকর্মী এবং অভিনেতা (যাঁদের রসিক মনে করেন) তাঁদের হাতে ফুলটি তুলে দেবেন। গায়ের থেকে চাদরটি খুলে তাঁদের উষ্ণতায় জড়িয়ে দেবেন। বলবেন, ‘তা হলে আসি’। আমরাও যে যার গন্তব্যে চলে যাব।
প্রণাম নেবেন সৌমিত্রদা। আপনাকে প্রণাম শব্দটা বলতেও কোথাও একটা থমকে যাই। কেননা, প্রণামের চেয়েও আপনি ভালবাসেন (অন্তত আমি যে সান্নিধ্য পেয়েছি তার থেকে বুঝেছি) উষ্ণতা। এবং জড়িয়ে ধরেন যখন (জড়িয়ে ধরেন নাও যখন) একরকম উষ্ণতা পেয়েছি। পাচ্ছি। আগামী দিনেও পাব। আমাদের অপেক্ষা থাক একটু উষ্ণতার জন্য। আমাদের অপেক্ষা থাক আপনার সেই সংলাপের জন্য। যে সংলাপ এখন আপনি আওড়াচ্ছেন।
আজ সন্ধ্যায় দেখা হবে। দেখা হবে গল্ফগ্রিনের বাড়িতে। দেখা হবে অন্যরকম কোনও সবুজের মধ্যে। আবারও প্রণাম, আবারও উষ্ণতা, এবং ভালবাসা।
ইতি,
আপনার দেবু (দেবশঙ্কর হালদার)।
আরও পড়ুন: Soumitra-Poulami: ‘‘কাজ করে বাপিকে ট্রিবিউট দিচ্ছি, এটাই তিনি চাইতেন’’: পৌলমী