জয়িতা চন্দ্র
লক্ষ্মীকান্তপুরের ‘কীর্তন বাড়ির ছেলে’ বলতে সকলে এক নামে চেনেন কীর্তনীয়া পদ্মপলাশকে। তাঁদের পরিবারে কেউ কোনওদিন চাকরি করেননি, ব্যবসাও করেননি। তিন পুরুষ ধরে তাঁরা শুধুই কবি গান আর কীর্তন গেয়েছেন। সেই পরিবারের ছেলে পদ্মপলাশ এখন জ়ি বাংলার রিয়ালিটি শো ‘সারেগামাপা’-র প্রতিযোগী। মঞ্চে আর পাঁচটা ঘরানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা কতটা কঠিন, TV9 Bangla-কে জানালেন পদ্মপলাশ।
কীর্তনকে সঙ্গী করে রিয়ালিটি শো-এর মঞ্চে পৌঁছবেন একদিন, ভেবেছিলেন কখনও?
আমি তো ছোট থেকেই কীর্তন করছি। আমি বহুদিন ধরে কীর্তনের সঙ্গে যুক্তও। ২০১৫ সালে সম্ভবত প্রথম যখন জ়ি বাংলায় দেখি যে কীর্তনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এভাবে কীর্তনকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। খুউব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তখন থেকেই মনে ইচ্ছে জাগে, বাংলার এত প্রাচীন ঘরানাকে নিয়ে আমরাও তো তাহলে এগিয়ে যেতে পারি… আমাদের মতো কীর্তনীয়া আজ নিজের গানকে এভাবে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে, এটাও তো দারুণ। অনেকেই আছেন যাঁরা ‘ভবিষ্যত কী হবে’ ভেবে ইচ্ছে থাকলেও এগোতে পারেন না। তাঁরা আমারই মতো সাহস পাবেন বলে মনে করি আমি।
এই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কি আপনার এলাকায় নতুনদের কীর্তনের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে?
হুমমম… নিশ্চয়ই। ‘কীর্তন গ্রামবাংলার কিছু নির্দিষ্ট এলাকাতেই সীমাবদ্ধ’, ‘কিছু মন্দির চত্বরে খোল-কর্তাল নিয়েই কীর্তন হয়’, মানুষের মনে এমন ধারণা এখনও রয়েছে। কিন্তু এখন তো সেই ছবি পাল্টাচ্ছে। মানুষ তো এখন কীর্তন শুনতে চাইছেন। অন্যান্য গান যেমন মানুষের কাছে জনপ্রিয়, তেমনই কীর্তনও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সকলের কাছে। আধুনিক গান বলুন, রক গান বলুন, কীর্তনও যে কোনও অংশে কম নয়, কীর্তনও যে পাল্লা দিয়ে সকলের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে, বিগত কয়েক বছরে তা প্রমাণিত। দেখুন, এতদিন পর্যন্ত আমি নিজে যা-যা গেয়েছি, বিচারকেরা প্রশংসা করেছেন। তাই-ই বলছি, কীর্তন যে কোনও অংশে কম জনপ্রিয় গান, কম প্রশংসিত গান, পিছিয়ে-পড়া গান, তা কিন্তু একেবারেই নয়। কীর্তন যে পাল্লা দিয়ে লড়াই করতে পারে, তা তো দেখাই যাচ্ছে।
আপনার দুই পূর্বপুরুষের কাছে কীর্তন বেশ সীমিত ছিল, এতটা প্রসার বা প্রচার তাঁরা দেখেননি। আপনার এই পালাবদল দেখে তাঁদের কী প্রতিক্রিয়া?
প্রতিক্রিয়া সত্যিই খুব ভাল। তাঁরা তো এভাবে কিছুই পাননি। আর সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বদল স্বাভাবিক। আর সেই বদলের হাত ধরে যে কীর্তন এগোচ্ছে, সেটা সত্যিই খুব আনন্দের। এভাবে প্রতিযোগিতার মঞ্চে কীর্তন পাল্লা দিচ্ছে, জায়গা করে নিচ্ছে, তাতে কীর্তনের কদর দিন-দিন বাড়বে, এখন এই আশা করাই যায়। সবকিছুতেই দৃষ্টিভঙ্গীর যে ফারাক এসেছে, বদল এসেছে, তা কীর্তনকেও প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে কীর্তনের উপস্থাপনাও পাল্টাচ্ছে। ফলে বাড়ছে আকর্ষণ। দেখুন, আগে যেভাবে গান রেকর্ড হয়েছে, বর্তমানে হুবহু তেমনভাবে পরিবেশনা করাটা এক কথায় কঠিন। তাই আমিও ভেবেছি, এই গানে নতুন কী যোগ করা যায়, যাতে মানুষ আরও বেশি করে কীর্তন শোনেন। তবে এই বদলে আমার গুরুজনদের কোনও ক্ষোভ নেই। বরং তাঁরা আশীর্বাদ করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন।
ঠিক কেমন ধরনের বদলের কথা বলছেন?
বদল কীর্তনের পবিত্রতাকে বজায় রেখেই… এমন নয় যে, বদল ঘটাতে গিয়ে কীর্তনের মধ্যে থাকা মাটির গন্ধকেই মুছে দিলাম। এখন আমি বহু ফোন পাই, কাছের মানুষদের থেকে তো বটেই, যাঁরা চিনছেন, আমার গান শুনছেন, পাশাপাশি বিদেশ থেকেও বহু ফোন আসছে আমার কাছে। এই নতুন ধরনের কীর্তন শুনতে তাঁরা ইচ্ছুক।
আধুনিক গান গাইয়েদের সংখ্যা বেশি, হঠাৎ করে কেউ কীর্তন গাইবেন এই সাহসটা অনেকেই দেখান না বা এই প্রবণতাটাও থাকে না। কেন?
দেখুন শেখার কোনও নির্দিষ্ট বয়স হয় না। যদি কেউ জানতে চান, ভালবাসতে চান, তবে তিনি যে কোনও সময়ই কীর্তন সাধনা করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে তালিমটা খুবই জরুরী। প্রতিটা জঁরের একটি নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। কীর্তনও তার ব্যতিক্রম নয়। যাঁরা নতুন আসবেন, তাঁদের কাছে এটা অজানা বিষয়। এটা শিখতে গেলে বাংলা সাহিত্য জানতে হবে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জানতে হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সম্ভব। আসলে এটাও একটা বড় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যে, আমরা কীর্তনকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি। সেক্ষেত্রে নতুনদের আসার প্রয়োজন তো রয়েছেই।
কীর্তন মানেই কী কেবল ধর্মীয় গান? বর্তমানে কীর্তন সাধনা কতটা উন্মুক্ত?
দেখুন কীর্তনের সঙ্গে তো ধর্মের এক যুক্তসূত্র বর্তমান। মহাপ্রভূর পরই তো কীর্তনের জোয়ার বয়ে গিয়েছে। তবে কীর্তন কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নয় সমাদৃত নয়, এর পিছনে এক ইতিহাস রয়েছে, সাহিত্য রয়েছে। সঙ্গীতেরও এক গভীর দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট না হলে সমস্যা হতে পারে। তাই-ই সঠিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। কেবল ধর্মীয় ঘেরাটোপে কীর্তনকে বেঁধে রাখতে আমি রাজি নই।