কুশল সিংহ রায়: পাবনার পুরোনো বাসিন্দা ঘটক পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বহরমপুরের শান্তিময় ভট্টাচার্যের। তখন ঋত্বিক ঘটক রাজশাহিতেই থাকতেন। রাজশাহি কলেজ থেকে বহরমপুরে এসে কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। ‘কোমল গান্ধার’-এর শুটিং হয়েছিল মুর্শিদাবাদের (Murshidabad) লালগোলার ঘাটে। সেই ঘাট এখন আর নেই। যেখানে দোহাই আলি গানের দৃশ্য তোলা হয়েছিল, সেই স্টেশন শান্তিময় ভট্টাচার্য দেখেছেন। চিরকাল ঋত্বিককে তিনি ভবাদা বলেই ডেকেছেন। শান্তিময় এখন বার্ধক্যের জেরে অবলম্বন ছাড়া হাঁটতে পারেন না। কিন্তু প্রখর স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে আনতে পারেন দেশভাগ ও তার পরবর্তী যাপনের কথা। হুগলির পুষ্প নন্দীর স্মৃতিতে এখনও টাটকা ওপার বাংলার বুকে তাঁর বিয়ের ফুলের সুবাস। বরপক্ষ নৌকায় করে জলপথে এসেছিল। আবার নৌকায় চেপেই স্বামী চিত্তরঞ্জনের হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি ঢোকেন। এমন কত কথা আজও তাঁরা মনে করতে পারেন।
‘বাংলার পার্টিশন কথা-উত্তর প্রজন্মের খোঁজ’ গ্রন্থের উপজীব্য এমনই তিরিশটি জীবনভাষ্য— সাতচল্লিশ ও একাত্তরে মানুষের ফেলে আসা মর্মান্তিক বেদনাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য একটা জনগবেষণামূলক প্রয়াস। অতীতে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় (Atin Bandopadhay), প্রফুল্ল রায়, দেবেশ রায়, অমর মিত্র প্রমুখ সাহিত্যিকরা দেশভাগের উপর বাঙালির আত্মকথন বুনেছেন। পরবর্তীতে অমিতাভ ঘোষ, কেতকী কুশারী ডাইসন, ঝুম্পা লাহিড়িদের ‘ডায়াস্পোরা’ সাহিত্যে উঠে এসেছে বাংলার পার্টিশন বা মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান অথবা রোজনামচায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে ‘হারানো দেশ’-এর স্মৃতিচর্বণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত গবেষণা পরিসরে উঠে এসেছে আমাদের চারপাশের নাম-না-জানা মানুষদের বয়ান, প্রথমবার। ট্রমা, ভায়োলেন্স ছাড়াও বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে ছড়িয়ে রয়েছে উদ্বাস্তু জীবনের দীর্ঘশ্বাস, যন্ত্রণা, গ্লানি এবং স্মৃতির রক্তক্ষরণ। এঁরা আগে কেউ এই নিয়ে বলেননি, লেখা তো দূর!
তিন খণ্ডে পরিকল্পিত ‘বাংলার পার্টিশন কথা-উত্তর প্রজন্মের খোঁজ’-এর প্রথম খণ্ড নিয়েই কথা হচ্ছে। শুরুতে বলা যাক এই উদ্যোগের জন্মকথা। নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ হিউম্যানিটিজ দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নেওয়া অভূতপূর্ব উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ‘বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি’। অনলাইন সংস্কৃতির যুগে বইয়ের হরফ ছাড়িয়ে যেখানে ডিজিটাল সংগ্রহে জমা রয়েছে মানুষের স্মৃতি ও কথন। রয়েছে তিনশোটির মতো ভিডিও। সেই জনগবেষণামূলক প্রকল্পই এবার গ্রন্থের আকারে ডানা মেলল মনন ও চিন্তনের রাজ্যে। কিন্তু কেন?
কী দরকার ছিল ইতিহাস পর্যবক্ষণের, হারিয়ে যাওয়া আইডেনটিটি খুঁজতে নামার? এই প্রকল্পটির পরিচালক অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডল বলেন, “উত্তর প্রজন্মের দেশভাগ বিষয়ে বোঝাপড়া সমকালের নেশন স্টেট জিজ্ঞাসা থেকে উঠে আসছে। স্মৃতির পরিসর, নাগরিকত্ব ও সামাজিক পরিচিতির জটিল আবর্ত পার্টিশনের ইতিহাস ও আখ্যান সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলছে এই প্রজন্মকে।“ মনন মনে করেন, “এমন একটা উদ্যোগ চাই, যেখানে বাংলার আখ্যানগত বিশিষ্টতা এবং প্রসারিত ভারতীয় গণতন্ত্রের গভীর থেকে একভাষিক পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের গল্প-আখ্যানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। নিরন্তর উঠে আসতে থাকা ব্যক্তিক বয়ানের মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালির পার্টিশন পীড়িত জীবনের ঠিকানা।”
শুধু তিরিশটি জীবনভাষ্য নয়, সঙ্গে রয়েছে সাতটি প্রবন্ধ ও সমীক্ষামূলক রচনা। শক্তিনাথ ঝা রচিত দেশভাগ নিয়ে বাউল ফকিরদের প্রতিবাদ বিষয়ক প্রবন্ধটি মননশীল এবং অনুসন্ধিৎসা জাগায়। শক্তিনাথ লিখেছেন, “দেশভাগ নিয়ে কোনো গণভোট হয়নি। মতুয়া, আউল, বাউল, ফকির, দরবেশ, কর্তাভজা, অবৈদিক বৈষ্ণব, বেসরা পীর, এবং সুফি প্রমুখ লোকধর্মের উপাসকেরা এই সিদ্ধান্তের প্রবল প্রতিপক্ষ।“ শা আব্দুল করিম, লালনের গান তারই ইঙ্গিত— “ধর্মের
আওতায় পড়ে একে অন্যকে মারে/ ধর্ম নিয়ে মারামারি ভারতকে বিভক্ত করে।”
অনিন্দিতা দাশগুপ্তের মু্ক্তিযুদ্ধ ও বেতার বিপ্লব নিয়ে প্রবন্ধটিও জাতি ও ইতিহাসচেতনার নামান্তর। ‘রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত বঙ্গদর্শন নবপর্যায় পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে খুব স্পষ্ট করে কবিগুরুর বঙ্গভঙ্গ নিয়ে চিন্তাভাবনা তুলে ধরা হয়েছে— “আমাদের সমাজ আছে, সমাজ ছিল; কিন্তু নেশন পূর্ব্বে কখনো ছিল না। এই জন্য আমাদের ধর্ম ছিল, কিন্তু পেট্রিয়টিজম ছিল না।” কিন্তু ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের পর শেষরক্ষা হয়নি, ১৯৪৭ সালে পুনরায় দেশবিভাগ হয়।
আজ স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে দেশভাগকে ‘উপনিবেশের ষড়যন্ত্র’ তকমা দেওয়া আর যথেষ্ট নয়। আবার হিন্দু-মুসলিম আজ বিভাজনের বাইনারি নয়, বরং রাষ্ট্রশক্তি-ভারসাম্য রক্ষায় এই মেরুকরণের চেষ্টা হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহে ৫০ জন শিক্ষক, গবেষক ও সমীক্ষকের এমন উদ্যোগে পাঠকদের সাড়া মিলবে বলে আশা করা যায়। সাড়া মিলেছে ওপারেও। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশভাগ বিষয়ে যৌথভাবে গবেষণার জন্য একটি মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বাংলার পার্টিশন-কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ
প্রস্তাবনা, সম্পাদনা ও গ্রন্থনা : মনন কুমার মণ্ডল
সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ
নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন: নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনতে শিখিয়েছেন তিনি, ৯০-এর দোরগোড়ায় আজ কবি শঙ্খ ঘোষ