১৫ অগস্ট। ক্যালেন্ডার বলছে, ভারতের স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় ছুটির দিন। হ্যাঁ, প্রশ্নটা এখানেই। শুধুমাত্র ছুটির দিন? বাড়িতে সকলে একসঙ্গে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া বা বেড়াতে যাওয়া? নাকি ব্যবহারিক জীবনে এর কোনও যথার্থতা রয়েছে? কী ভাবছেন নতুন প্রজন্ম? নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি টলিউডের দুই শিল্পী স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে তাঁদের ধারণা শেয়ার করলেন TV9 বাংলার সঙ্গে।
দিতিপ্রিয়া রায় (অভিনেত্রী, আশুতোষ কলেজের স্নাতক স্তরের প্রথম বর্ষের ছাত্রী)
১৫ অগস্ট আমার কাছে সব সময়ই বিশেষ একটা দিন। আলাদা দিন। সেলিব্রেট করার মতো দিন। স্বাধীনতা কী বা কাকে বলে সেটা বোঝার আগে থেকেই এই দিনটা ঘিরে আলাদা উত্তেজনার আঁচ পেয়েছি। কারণ আমার স্কুল। পাঠভবন।
স্বাধীনতা দিবসের প্রায় এক মাস আগে থেকে আমাদের রিহার্সাল শুরু হয়ে যেত। নানা রকম প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকতাম। ওই দিন স্কুলে গিয়ে পতাকা তোলার মধ্যে যে একটা আলাদা ফিলিং হত, সেটা কিন্তু স্কুলে থাকতেই বুঝতে পেরেছি। পাঠভবন-এ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সব সময় ছিল। ফলে যে কোনও অনুষ্ঠান আমরা খুব পরিশ্রম করে, আনন্দ করে পালন করতাম। আমার মনে আছে রেড রোডে ফাংশন হত। অনেক স্কুল অংশগ্রহণ করত। আমারও অংশ নিয়েছিলাম এবং সেকেন্ড প্রাইজ় পেয়েছিলাম। সেই পুরস্কারের অর্থ স্কুলের তরফে কেরলের বন্যাত্রাণে দান করা হয়েছিল।
ফলে স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে কখনওই শুধুমাত্র একটা ছুটির দিন নয়। বাড়িতে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া অথবা বেড়াতে যাওয়া, কোনওটাই করিনি। বরং স্কুল আমাদের এই দিনটার আলাদা অর্থ ভাবতে শিখিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে সেই পরিবেশেই বড় হয়েছি। নিজের স্বাধীন যে চিন্তা ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার কৃতিত্বও তো স্কুলের অনেকটাই। কোনও রকম কাজ ছাড়া শুধু ছুটির দিন হিসেবে ১৫ অগস্টকে দেখতে শেখায়নি আমার স্কুল।
এখন প্যানডেমিকের জন্য তো কোনও সেলিব্রেশন হচ্ছে না। রেড রোডেও কোনও বড় অনুষ্ঠান হবে না হয়তো। আমার এখন কলেজ। আশুতোষ। কলেজ শুরু হওয়ার পর থেকে পুরোটাই অনলাইন ক্লাস। আর আমি যে কাজ করি, সেখানে কিন্তু ১৫ অগস্ট ছুটি থাকে। স্বাধীনতা দিবসে সাধারণত আমাদের ছুটি থাকে না। এ বছর স্কুল নেই। কলেজও অনলাইন, ফলে সেখানকার সেলিব্রেশন কেমন আমি জানি না। আবার শুটিংও নেই। ফলে এই বছরটা হয়তো আমার কাছে ছুটির দিন। কিন্তু এই দিনের আসল অর্থ, স্বাধীন দেশে জন্মানো, নিজে স্বাধীন থাকার চিন্তা, চেতনা, স্বাধীন থাকার অভ্যেস সেই অনুশীলন আমার মধ্যে চলতেই থাকবে প্রতিদিন। স্বাধীনতা আমার কাছে সেলিব্রেশনের, সেটা যে ফর্মেই হোক।
ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় (অভিনেতা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি বছরের স্নাতক)
কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছরই গ্র্যাজুয়েট হলাম। এখনই মাস্টার্স করব না। বাইরে যাব পড়তে, তেমন ইচ্ছেই আছে। এ বছরই হয়তো যেতাম। সিলেক্টেডও হয়েছিলাম। ফাইনালি গেলাম না। ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করব ভেবেছি। এগুলো বললাম, কারণ আমি যাদের সঙ্গে মেলামেশা করি, আমি যাদের বন্ধু বলি, তারা স্বাধীনতা কনসেপ্টটা নিয়ে অনেক সচেতন। ছোট থেকে যে সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস পড়েছি বা তথ্যচিত্রে দেখেছি, তা থেকেই স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা অনেক পরিস্কার। ঔপনিবেশিক ভারত কেমন ছিল আর এখন কেমন, সমাজব্যবস্থার দিক থেকে কতটা বদল, সেটা স্পষ্ট। ফলে আমি স্বাধীনতা দিবস, স্বাধীনতা নিয়ে যা কিছু বলব তা অপটিমিস্টিক নয় হয়তো।
এখনও আমাদের দেশে অনেক কিছু হয়, যা স্বাধীনতার একেবারে উল্টো। শুনতে মিষ্টি লাগবে, এমন কথা বলতে পারব না। স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে একটা দিন নয়। যদি সত্যিই স্বাধীন হতে হয়, অনেক কিছু থেকে স্বাধীনতা পেতে দেরি আছে আমাদের। মূলত মানসিক স্বাধীনতা দরকার। বাবা-মায়ের জেনারেশনের সঙ্গে অনেক মতের অমিল রয়েছে আমার। আবার মিলও আছে। সে সব স্বাধীনতার দরকার।
১৫ অগস্ট দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু সেটা তো একটা দিন সেলিব্রেট করার মতো নয়। এটা তো অনেকটা রবীন্দ্রনাথকে বছরে দু’টো দিন সেলিব্রেট করার মতো হয়ে গেল। ২৫ বৈশাখ, আর ২২ শ্রাবণ। সারা বছর তাঁর শিক্ষা কাজে লাগাচ্ছি না, দু’টো দিন ‘ঠাকুর’ পুজো করছি। এর যেমন কোনও অর্থ আমার কাছে নেই। তেমনই ১৫ অগস্ট একটা দিন স্বাধীনতা দিবস পালনের কোনও মানে নেই। বরং যে সব জায়গায় আজও আমরা পরাধীন, সে সব জায়গায় স্বাধীনতা খুঁজতে হবে।
তবে সেলিব্রেট করারও দরকার আছে। একটা দেশ, তার ইতিহাস আছে। এই একটা দিন পতাকা উত্তোলন, গান বাজানো, বক্তৃতা এগুলো রিচুয়াল আমার কাছে। সেই ট্র্যাডিশনটা ঠিক আছে। কিন্তু এই একটা দিন স্বাধীন, বাকি দিনগুলো পরাধীন তা নয়। আমরা আসলে বড্ড একটা দিনই সেলিব্রেট করি।
আমি শ্রী অরবিন্দ ইনস্টিটিউড অব কালচারে পড়তাম। ১৫ অগস্ট অরবিন্দেরও জন্মদিন। স্কুলে একটা মিলিত অনুষ্ঠান হত। ইউটিউবে সেগুলো আছে। সেটা দেখি এখনও মাঝেমাঝে। ২০১৯-এ শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম ১৫ অগস্টে ওঁদের অনুষ্ঠান দেখার জন্য। বিশ্বভারতীর সেলিব্রেশন ভাল লেগেছিল। আর যাদবপুরে আলাদা কোনও সেলিব্রেশন আমি দেখিনি।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।
আরও পড়ুন, স্কুলে জিলিপি পার্টি অথবা টুপি পরা লোকের জন্মদিন, স্কুল পড়ুয়া এই চার খুদে শিল্পীর স্বাধীনতা দিবস…