সত্যজিতের ফিল্মের ফোকাস সঠিক রাখা মানুষটার চোখের ফোকাসই আজ নষ্ট

TV9 Bangla Digital | Edited By: স্বরলিপি ভট্টাচার্য

Aug 04, 2021 | 9:11 AM

অনিল ঘোষ। সত্যজিতের ফোকাস পুলার। সত্যজিৎ রায়ের পুত্র পরিচালক সন্দীপ রায়ের মতে “অনিল ছিলেন বাবার ইউনিটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য”। সত্যজিৎ নিজেই যেহেতু ক্যামেরা অপারেট করতেন। তাই অনিল আক্ষরিক ভাবেই ছিলেন সত্যজিতের ‘ঘনিষ্ঠ’।

সত্যজিতের ফিল্মের ফোকাস সঠিক রাখা মানুষটার চোখের ফোকাসই আজ নষ্ট
অ্যাকশন বলার আগের মুহূর্তে সত্যজিতের সঙ্গে অনিল

Follow Us

নন্দন পাল: পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষ চলছে এই বছর জুড়ে। তাঁর ইউনিটের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের গল্প রইল আজ । তিনি অনিল ঘোষ। সত্যজিতের ফোকাস পুলার। সত্যজিৎ রায়ের পুত্র পরিচালক সন্দীপ রায়ের মতে “অনিল ছিলেন বাবার ইউনিটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য”। সত্যজিৎ নিজেই যেহেতু ক্যামেরা অপারেট করতেন। তাই অনিল আক্ষরিক ভাবেই ছিলেন সত্যজিতের ‘ঘনিষ্ঠ’। কাজের প্রয়োজনে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় সহকারী হিসাবে কাজ করতেন অনিল ঘোষ। ছিল ফটোগ্রাফির নেশা। তখন ১৯৬২ পেশায় সহকারী ক্যামেরাম্যান অনিল শুনলেন সত্যজিৎ রায় একটি অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা কিনেছেন এবং ওই ক্যামেরাটির জন্য লাগবে একজন কেয়ারটেকার। পরিচিত এক সহকর্মীর কাছে এ কথা শুনে অনিল গেলেন লেক টেম্পল রোডে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। তাঁকে পরখ করে নিজের সদ্য কেনা ক্যামেরার ‘কেয়ারটেকারের’ কাজে বহাল করলেন বরেণ্য পরিচালক। সেই শুরু হল। প্রথমে ক্যামেরা কেয়ারটেকার হিসাবে তারপর ১৯৬৫তে সত্যজিৎ যখন কাপুরুষ মহাপুরুষ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন প্রয়োজন হল দুটি ক্যামেরা ইউনিটের। সেই দুটি ইউনিটের একটির ফোকাস পুলার হিসাবে কাজ শুরু করলেন অনিল।

কেবল মাত্র ফোকাস পুলিংই নয়। অ্যানালগ মিচেল বা অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা মাউন্ট করা, তাতে লেন্স লাগানো, ফিল্ম রোল লোড করা ইত্যাদি সমস্ত কাজই দক্ষতার সঙ্গে করতেন অনিল ঘোষ। কাপুরুষ মহাপুরুষ পরবর্তী সত্যজিৎ রায়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সব ছবিকে ঠিকঠাক ফোকাসে রেখেছিলেন এই মানুষটি। অনিল ঘোষ। আজ তাঁর নিজের চোখের ফোকাসই বেসামাল। সত্যজিৎ ছাড়াও চিদানন্দ দাসগুপ্ত, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ সহ বহু পরিচালকের সঙ্গে প্রায় ৩০০ রও বেশি ছবিতে কাজ করেছেন আমাদের প্রবীণ এই সহনাগরিক। সত্যজিতের ১৭টি ফিচার ফিল্ম ৪ টি ডকুমেন্টারি আর একটি শর্ট ফিল্মে কাজ করেছেন অনিল। নায়ক, চিড়িয়াখানা,গুপী গাইন বাঘা বাইন, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী,সীমাবদ্ধ, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, জন অরণ্য, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, সদ্গতি, ঘরে বাইরে, গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা আর আগন্তুকে সত্যজিতের ইউনিটের বিশ্বাসযোগ্য সেনানী হয়ে থেকে গেছেন অনিল।

 

অশনি সংকেতের সেটে

এরই মধ্যে সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করতে করতে শিখেছেন ক্রিয়েটিভ ক্যামেরা টেকনিক। মিচেল আর অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরার খুঁটিনাটিও ততদিনে নখদর্পনে এসেছে। আজও অনিল ঘোষের স্মৃতির পটে ঝকঝকে সেসব দিন। আজও মনে পড়ে ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ এর ভুতের নাচের ক্রিয়েটিভ ক্যামেরা টেকনিক বা ‘সোনার কেল্লা’য় পোখরান স্টেশনে শ্যুট করা সিল্যুয়েট শট । সত্যজিতের নিখুঁত কাজের পদ্ধতি প্রভাবিত করছে তরুণ অনিলের সত্ত্বাকেও। ধীরে ধীরে অন্য পরিচালকদের সঙ্গেও গড়ে উঠেছে সখ্যতা। অজয় কর কিংবা অগ্রদূতের পরিচালকদের শ্যুটিং ফ্লোরে অনিলের যাতায়াত ছিল অবাধ। ক্যামেরা আর ফিল্মের টেকনিক্যাল দিকের নেশায় তখন মত্ত অনিল ঘোষ। ধীরে ধীরে পরিধি প্রসারিত হতে লাগল। ইস্টার্ন ইন্ডিয়া সিনেমাটোগ্রাফার অ্যাসোসিয়েশনের সহ সম্পাদক হলেন অনিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট সিনেমাটোগ্রাফার অ্যাসোসিয়েশনেও হলেন পদাধিকারী। সত্যজিতের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও ঘনিষ্ট হতে লাগল। অনিলকে সন্তান সম স্নেহ করতেন সত্যজিৎ আর তাঁর বিজয়া রায়ও মাতৃসম স্নেহ করতেন অনিলকে। অনিলের স্ত্রী অঞ্জু ঘোষ যখন সন্তান সম্ভবা হলেন বিজয়া রায় স্থির করলেন অনিল – অঞ্জুর সন্তানের নামকরণ করবেন তিনিই। এরপর অনিলের একটি পুত্র সন্তান হয়। বিজয়া রায় তার নাম রাখেন অঙ্কুশ। সত্যজিৎও খোঁজ খবর রাখতেন অঙ্কুশের পড়াশোনার।

তারপর ছেলে অঙ্কুশ বড় হতে লাগল। অনিলও মত্ত হয়ে গেলেন তাঁর কাজে। “অরণ্যের দিন রাত্রি” র শ্যুটিংয়ে গিয়ে পায়ে চোট পেলেন। কলকাতায় ব্রাজিলের পেলের ম্যাচে রামানন্দ সেনগুপ্তের সহকারী হিসাবে কাজ করলেন অনিল। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল অনিলের। অঙ্কুশ তখন পড়াশোনার পাশাপাশি খেলছে ক্রিকেট। এরপর একটি অঙ্কুশ চাকরি পেল। বাবা মায়ের ভরসা হয়ে পাশে দাঁড়াল। কিন্তু ২০১০ এর ২৩ মার্চের দুপুরে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ড অনিল আর অঞ্জুর জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল। ছেলে অঙ্কুশ তাঁর সহকর্মীদের ওই আগুনের সর্বগ্রাসী শিখা থেকে বাঁচাতে গিয়ে জ্বলন্ত কাঠের সিঁড়ির তলায় চাপা পড়ে মারা গেল। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর অঞ্জু স্টিফেন কোর্টে গিয়ে শনাক্ত করলেন ২৭ বছরের একমাত্র সন্তানের নিথর দেহটি।

চোখে গ্লুকোমা, এখন স্মৃতিই সম্বল

স্মৃতিরা ভিড় করে আসে। একাঘরে একরাশ সাদা কালো ওয়ার্কিং স্টিল ফটোগ্রাফ ছড়িয়ে অনিল বসে থাকেন। পশ্চিমের জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় উড়ে যায় সেসব। মন মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। যেন নেপথ্যে বাজতে থাকে হীরক রাজার দেশের অমোঘ সংলাপ ,

” বয়স কারও ধার ধারে না বেড়েই চলে , তাইতো শুনি তাই তো লোকে বলে।
আজ যারা চারা কাল তারা মস্ত বড় গাছ ,আজকে পুঁটি কাল সে বোয়াল মাছ
আজ যারা দেয় হামাগুড়ি কালকে তারাই বুড়োবুড়ি
আজ যে হাতে চুষিকাঠি কাল সে হাতে ধরবে লাঠি।
আজ যারা টেরি কাটে কালকে তাদের চাঁদি ফাটে – কেন
চুল গিয়ে যে টাক পড়েছে, যাও বা আছে পাক ধরেছে। ”

ফেলে আসা সময়টাকে রিওয়াইন্ড করতে পারলে ভাল হত, ভাবেন বিষন্ন অনিল ঘোষ।একবার সুযোগ এসেছেল কলকাতা দূরদর্শনে চাকরির ইণ্টারভিউ দেওয়ার। তখন শুরু হচ্ছে দূরদর্শনের বাংলা সম্প্রচার। অনিল মনস্থির করেছিলেন দূরদর্শনে চাকরির দরখাস্ত করবেন। “শুধু মানিকদার একটা চিঠি পেলেই চাকরি হয়ে যেত আমার। কথাটা মানিকদাকে বলতে উনি বললেন তুমি কোথাও যাবে না আমার ইউনিটেই থাকবে” আজও মনে পড়ে অনিল ঘোষের ভাবেন এই আশক্ত, বৃদ্ধ বয়সে দূরদর্শনের পেনসন থাকলে খুব সুবিধা হত। এখন বয়স আশি ছুঁইছুঁই। চোখে গ্লুকোমা , হৃদযন্ত্রের সমস্যা, পায়ে যন্ত্রণা। যে মানুষটা আমাদের প্রিয় সিনেমাগুলির ছবি ঝকঝকে রেখেছেন আজ তাঁরই দৃষ্টি ঝাপসা। চলতে গেলেও ভয় পড়ে যাওয়ার। তার সঙ্গে পুত্র বিয়োগের শোক। অর্থের অভাবে করতে পারেন নি বাইপাস সার্জারি বা গ্লুকোমার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। আজ তাঁর বর্তমানটাই আউট অফ ফোকাস। সত্যজিতের চিরন্তন সৃষ্টি গুলো কিন্তু একই রকম ঝকঝকে এটুকুই তাঁর প্রাপ্তি। শূন্য দৃষ্টিতে অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকেন মানিকদার স্নেহের অনিল।

স্মৃতিরা ভিড় করে আসে

Next Article