সন্দীপ রায়: সকলে রবিকাকাকে ‘কমিডিয়ান’ বলেন। আমি সে সব একেবারেই মানি না। রবিকাকা একজন অত্যন্ত উঁচু স্তরের চরিত্রাভিনেতা। প্রথম যখন রবি ঘোষকে বাবা দেখেছিলেন, সেটা ‘মেঘ’ বলে একটি ছবিতে। উৎপলদা (উৎপল দত্ত) পরিচালনা করেছিলেন। আমিও দেখেছিলাম সেই ছবি। সেখানে রবিকাকার একটা ছোট্ট রোল ছিল। সেই দেখে বাবার ভীষণ ভাল লেগেছিল। তারপর দেখা করতে চাইলেন। রবিকাকা এলেন এবং বাবার কথা বলে এত ভাল লাগল, যে ‘অভিযান’ ছবিতে রবিকাকা কাস্ট হয়ে গেলেন। সৌমিত্রবাবুর পাশাপাশি একটা দারুণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। আমরাও সেই শুটিং দারুণ উপভোগ করেছিলাম। ওই আউটডোর আমার এখনও মনে আছে।
বীরভূম জেলার দুবরাজপুর এলাকায় শুটিং হয়েছিল ‘অভিযান’-এর। পরিষ্কার মনে আছে, স্টুডিয়োতে একটা খাবার দৃশ্য শুট করা হচ্ছিল। রাতেরবেলায় নার্সিংয়া রামা (ছবিতে রবি ঘোষের চরিত্রের নাম) খাচ্ছে। তখন যেটা দেখলাম, এর আগে সেরকম কিছু দেখিনি। তখন আমার কতই বা বয়স। ৯ কি ১০! দেখছি একজন অভিনেতা খাচ্ছেন এবং খাওয়ার মাঝেমাঝে সংলাপ বলছেন। সেটা আমার কাছে ভীষণই অদ্ভুত লেগেছিল। আজও অদ্ভুত লাগে। কারণ তার আগের ও পরের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে আমি দেখেছি, অনেক অভিনেতা আছেন, যাঁরা খাবার খাওয়ার দৃশ্যে খুব ভাল করে খান কিন্তু সংলাপ বলতে ভুলে যান। অনেকে আছেন, যাঁরা খুব ভাল সংলাপ বলেন, কিন্তু সেরকমভাবে খান না। কিন্তু রবিকাকা সেদিক থেকে ছিলেন একেবারে এক্সপার্ট। খুব কম অভিনেতাকেই আমি দেখেছি, যিনি খেতে খেতে কথা বলতে পারেন। সেই স্মৃতিটাই আমার খুব বেশি করে মনে পড়ে।
‘অভিযান’-এর পর থেকে রবিকাকা আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেলেন। ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’-এ ফিরে এলেন। মহাপুরুষের চেলার রোল করলেন। তারপরে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটে গেল। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলে এল। সেখানে বাবা প্রথম কার্স্টিং রবি কাকুকেই করেছিলেন। গুপী নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তারপর তপেনদা এসে ব্যাপারটাকে একেবারে জমিয়ে দিলেন। কিন্তু ততদিনে রবিকাকা আমাদের রায় পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। খুব নিয়মিতভাবে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কেবল অভিনয়ের জন্য, তা কিন্তু নয়। প্রতি রবিবার, যখন শুটিং হত না, আড্ডা বসত আমাদের বাড়িতে। ফ্রি থাকলে সেখানে নিয়মিত রবিকাকাও যোগ দিতেন। কাজেই একটা অন্যরকম সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। বাবার সঙ্গে একটা অদ্ভুত কেমিস্ট্রি তৈরি হয়ে গিয়েছিল রবিকাকার। যে কারণে বাবা ওঁকে খুবই পছন্দ করতেন। ওঁর কাজকে ভীষণই সম্মান করতেন এবং স্বাধীনতাও দিতেন। যেটা অনেককে উনি হয়তো দিতেন না।
বাবা বলতেন, “রবি তোমার যদি কিছু মনে হয় করতে পারো। আমার যদি ইন্টারেস্টিং মনে হয়, সেই শট আমি রেখে দেব।” যেমন ‘অভিযান’-এ একটা সিন ছিল। দূরে গিয়ে একটা মোষকে টপকে চলে যাওয়া। সেটা কিন্তু বাবার বলা ছিল না। কিন্তু রবিকাকা করেছিলেন নিজে থেকেই। সেটা বাবা ছবিতে রেখেছিলেন। কাজেই এই ধরনের ছোটখাটো জিনিস বা স্পার্কস ছিল রবিকাকার।
রবিকাকার সঙ্গে কাজ করা ওঁর কো-অ্যাক্টারদের পক্ষে খুব অসুবিধার ছিল। তিনি দৃশ্য চুরি করে নিতে পারতেন অনায়াসেই – ‘সিন স্টিলার’ যাঁকে বলে। হয়তো সিনটা অন্য একজনের। কিন্তু উনি যদি পাশে থাকেন, এমন সব জিনিস করবেন, সব ফোকাস কেড়ে নিতেন। ফলে সহ-অভিনেতাদের খুব অসুবিধা হত।
রবি কাকার করা ‘বাঘা’র চরিত্রটা এখন একটা কাল্ট স্টেটাসে চলে গিয়েছে। এর মাঝে অন্যান্য কাজও হয়েছে। আমি কাজ করলাম ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’তে। ১০ বছরের গ্যাপে। কিন্তু কে বলবে সেই গ্যাপ ছিল। মনেই হয়নি কিছু। পরে রবিকাকা অনেক জায়গাতেই বলেছিলেন, “আমি অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছি, কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর মানুষ যদি আমাকে ‘বাঘা’ বলে মনে রাখেন, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হবে”। বাঘার প্রতি ওঁর একটা অদ্ভুত দুর্বলতা ছিল। আর দুর্বলতা ছিল ‘জনঅরণ্য’-এর নটবর মিত্তিরের উপরে। এমনভাবে সেই চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যে বাইরের একজন সমালোচক রবিকাকাকে মুশিয়ে বার্দুর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
রবিকাকার চলে যাওয়া আজও আমি মানতে পারি না। টেলিভিশনের জন্য ফেলুদার গল্প ‘গোসাইপুর সরগরম’ এডিট করছিলাম। রবিকাকা জটায়ু হয়েছিলেন। এডিট করার সময়তেই চলে গেলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে মনিটরে রবিকাকার মুখটা ভেসে উঠেছে, একজন এসে খবর দিলেন রবিকাকা চলে গিয়েছেন। আজও একই ভাবে রবিকাকার মুখটা ভেসে উঠতে দেখি।
গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ