Nandikar-Sohini-Swatilekha-Madhabi: “মায়ের একটা ভয় ছিল, তিনি মনে করতেন আমি টেলিভিশনে অভিনয় করতে গিয়ে ‘নান্দীকার’-এ অভিনয় করব না”, বলেছেন সোহিনী সেনগুপ্ত
স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর প্রয়াণের পর এই প্রথম 'মাধবী' নাটকটি মঞ্চস্থ হবে কন্যা সোহিনী সেনগুপ্তর নির্দেশনায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর ফের নাটক মঞ্চস্থ করবে 'নান্দীকার'। আজই (১৯.১১.২০২১) শো। মায়ের অনুপস্থিতি, তাঁর শূন্যতা, সবটা নিয়েই TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সোহিনী সেনগুপ্ত।
অভিনেত্রী, নাট্যব্যক্তিত্ব, নির্দেশিকা, সঙ্গীতশিল্পী—স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর পরিচয় অনেক। তাঁরই নির্দেশিত কালজয়ী নাটক ‘মাধবী’ ফের মঞ্চস্থ হতে চলেছে আজ, শুক্রবার ১৯ নভেম্বর। তবে তিনি অনুপস্থিত। না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর এই প্রথম নাটকটি মঞ্চস্থ হবে কন্যা সোহিনী সেনগুপ্তর নির্দেশনায়। আর সেই নাটকের হাত ধরেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর ফের নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করবে ‘নান্দীকার’। মায়ের অনুপস্থিতি, তাঁর শূন্যতা নিয়েই মহড়া চলেছে। TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে নস্ট্যালজিয়ায় ভাসলেন সোহিনী সেনগুপ্ত।
প্রশ্ন: মায়ের (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) মতো আপনিও একজন বহুমুখী প্রতিভা। একাধারে অভিনয়, নির্দেশনা, শিক্ষকতা, সংসার… সবটা জুড়ে থাকেন। স্কুল খুলেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর ‘নান্দীকার’-এর প্রথম নাটক। সবটা মিলিয়ে ফের তুমুল ব্যস্ততা… প্রথমে স্কুলের ব্যাপারটা বলুন। অনলাইন ক্লাস করানোর ব্যাপারটা তো চলে গেল। ফের ক্লাসরুমে ছাত্রীদের মুখোমুখি হচ্ছেন…
উত্তর: স্কুলে ফেরাটা আমার কাছে দারুণ বিষয়। অনেকদিন থেকেই স্কুলে ফিরতে চাইছিলাম। কারণ আমি অনলাইন লেখাপড়ার খুব একটা পক্ষপাতি নই। এই মাধ্যমে বিশ্বাস করি না। আমি পুরনো পন্থায় বিশ্বাসী। আমি বাড়ি থেকে বেরনোতে বিশ্বাস করি। সামনাসামনি আলাপচারিতায় বিশ্বাস করি। মেয়েগুলোকে ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাডে দেখায় বিশ্বাস করি। ফলে স্কুল ফুলেছে, এটায় আমি সুপার এক্সাইটেড। আমি সক্কাল-সক্কাল স্কুলে চলে আসি। ৮.৩০টায় পৌঁছে যাচ্ছি স্কুলে।
প্রশ্ন: এবার যদি স্কুল থেকে সোজা নাটকের মঞ্চে চলে আসি। সেখানেও তো একই বিষয় ঘটেছে। অনেকগুলো দিনের অপেক্ষার পর দ্বিতীয় ওয়েভের ভ্রুকুটি কাটিয়ে ‘নান্দীকার’-এর প্রথম শো আজ, ১৯ নভেম্বর।
উত্তর: জানেন তো মজার বিষয়, আমরা কিন্তু ভার্চুয়ালি নাটক করতে চাইনি। আর করিওনি। তবে বাচ্চাদের কিছু ক্লাস আমরা ভার্চুয়ালি করেছিলাম। ওদের মহাভারতের গল্প বলার মতো বিষয় নেট মাধ্যমের সাহায্যে হয়েছে। প্রথম লকডাউনের পরেই আমরা স্কুল খুলে দিয়েছিলাম। কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে আসত, কিন্তু সবাই এসেছে।
প্রশ্ন: সামনেই তো আপনাদের দু’টি নাটক মঞ্চস্থ হবে, ‘মাধবী’ আজ, ১৯ নভেম্বর আর ‘মানুষ’ ২৮ নভেম্বর। ওয়ার্কশপও চলছে সেই সঙ্গে। ‘মাধবী’ নাটকটির নির্দেশক ছিলেন আপনার মা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। তিনি এই নাটকের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছিলেন। আজ প্রথম নাটকটি জনসমক্ষে মঞ্চস্থ হবে ওঁর নির্দেশনা ছাড়া। শূন্যতা তো আছেই। বিষয়টা কতটা চ্যালেঞ্জের আপনার কাছে?
উত্তর: দেখুন, একই জিনিস অভিনয় করব। আলাদা কিছুই নেই। কিন্তু মাকে মিস করাটাই আমার কাছে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। আমার মন খারাপটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। সেই মন খারাপের চ্যালেঞ্জ নিয়েই মঞ্চে উঠব।
প্রশ্ন: আপনার আত্মবিশ্বাস আগে থেকেই ছিল। মায়ের অনুপস্থিতি, তাঁকে মিস করা, তাঁকে ছাড়া একটা কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা করা, এতে কি আরও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে? হয় না, অভিভাবক চলে গেলে মানুষটা অনেকটা বড়, অনেকটা পরিণত হয়ে যান…
উত্তর: সত্যি বলতে কি আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। আমি এমনিতেই খুব আত্মবিশ্বাসী। মায়ের চলে যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। মা তো বন্ধু ছিলেন। অভিভাবক ছিলেন। মাকে ছাড়া পথ চলতে হচ্ছে। ফলে এক ধাক্কায় যেন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি। মা আছেন জেনেই চলছি। অনেকটা ম্যাচিওরড হয়েছি। আরও একটা বিষয়ে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, সেটা হল এই লকডাউন।
প্রশ্ন: ‘মাধবী’ নাটকটি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত নিজের মতো করে নির্দেশনা করতেন। আপনি কি কোনও পরিবর্তন এনেছেন সেখানে?
উত্তর: এটা ‘মাধবী’ নাটকের ১৮৩ নম্বর শো। পরিবর্তন আনার কোনও ব্যাপার নেই। কিছু রিপ্লেসমেন্ট হয়েছে ক্রাউড টিমের অভিনেতাদের মধ্যে। অনেকেই অন্যান্য চাকরি পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছেন। কিন্তু মূল বিষয়টা হুবহু একই আছে।
প্রশ্ন: নির্দেশনা ও অভিনয় একই সঙ্গে—কোথাও কি বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে?
উত্তর: আমাকে আলাদা করে কোনও নির্দেশনা করতে হয়নি। যে যেমন পাঠ করেন, করছেন। কাউকে সেভাবে ডিরেক্ট করতে হয় না। প্রত্যেক অভিনেতাই প্রচণ্ড শৃঙ্খলাপরায়ণ। আমাদের দলটাও খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। ফলে কাউকেই ‘আয় রে, বাবারে বাছারে’ করতে হয় না।
প্রশ্ন: মায়ের নির্দেশনায় যখন নাটকটা করতেন, বারবার করে কোনও স্মৃতি ফিরে আসে?
উত্তর: মা এক্কেবারে সামনে কিংবা উইংয়ের পাশে বসে থাকতেন এবং কথায়-কথায় হাততালি দিতেন। মায়ের কাছে পৃথিবীতে দু’জন অভিনেত্রী ছিলেন, যাঁদের তিনি রিগার্ড করতেনঃ একজন মেরিল স্ট্রিপ, অন্যজন আমি। তিনি মনে করতেন মেরিল স্ট্রিপ ও সোহিনী সেনগুপ্তই একমাত্র অভিনেত্রী। তাই যে নাটকই মা বাছতেন, দেখতাম আমাকে কেন্দ্র করেই বানানো হচ্ছে। এবং ভীষণ প্রশংসা করতেন।
প্রশ্ন: এটাই তো জীবনের সেরা শংসাপত্র…
উত্তর: একেবারেই। কিন্তু এটাও বলে রাখি, আমি যদি কখনও খারাপ অভিনয় করতাম, মা সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, “তুই কিন্তু আজ এই জায়গাটা পারিসনি।” বা হয়তো বলতেন, “তুই সকালে গলাটা প্র্যাকটিস করিসনি।” বা, “তুই আজকে এক্সারসাইজ় না করে স্টেজে উঠেছিস।” এটা মা আমাকে সরাসরি বলতেন। শিল্পের ব্যাপারে মা অত্যন্ত সৎ একজন মানুষ ছিলেন।
প্রশ্ন: মা-ই তো আপনার অভিনয়ের প্রথম শিক্ষাগুরু। মা ও গুরুমা, মায়ের দু’টি সত্ত্বাকে কীভাবে আলাদা করবেন?
উত্তর: আমি আলাদা করতে পারব না। মায়ের থেকে আমি জীবনের অনেককিছু শিখেছি। কীভাবে বাঁচতে হয়, কীভাবে স্বাধীন হতে হয়, কীভাবে পয়সা রোজগার করতে হয়… মা একটা দারুণ কথা আমাকে বলতেন, “প্রত্যেকদিন রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বেরবে, বাড়ি থেকে বেরলে নিজের টাকা নিজে রোজগার করতে পারবে। আর বাড়িতে যদি বসে থাকো, রোজগার করতে পারবে না।” ফলে আমি চিরকাল রোজগার করেছি। কোনওদিনও আমাকে বাবা-মায়ের টাকা পয়সার উপর নির্ভর করতে হয়নি। এটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সবসময় প্রচুর কাজ করেছি এবং টাকা রোজগার করেছি। চেষ্টা করেছি ৫ পয়সার জন্যেও যাতে কারওর উপর নির্ভর করতে না হয়।
প্রশ্ন: আজ মাকে ছাড়া প্রথম ‘মাধবী’ নাটকের পারফরম্যান্স… কতটা মিস করছেন মাকে?
উত্তর: মা আমার সঙ্গেই আছেন। কোনওদিনও যায় না, যেদিন আমি মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি না।
প্রশ্ন: কী-কী দেখেন স্বপ্নে?
উত্তর: ভাল-মন্দ সবই দেখি। কষ্ট হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কী, কষ্টটা আমার নিজের… ব্যক্তিগত। কারওর সঙ্গে শেয়ার করি না। কষ্টটা আমাকে শক্তি দেয়। মনে হয়, আমিও তো একদিন বিলীন হয়ে যাব। তখন আমার আবার মায়ের সঙ্গে দেখা হবে।
প্রশ্ন: জন্মান্তরে বিশ্বাস করেন?
উত্তর: আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি এনার্জিতে বিশ্বাস করি। সমস্ত এনার্জি তো মৃত্যুর পর মিলেমিশে যায়, সেই বিশাল এনার্জির মধ্যে নিশ্চয়ই আমার মায়ের এনার্জিও আছে। যতদিন বাঁচব পারফর্মার হয়ে মাকে সম্মান জানিয়ে যাব। প্রচুর পরিশ্রম করব।
প্রশ্ন: স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর সঙ্গে যতবারই কথা হয়েছে, যতবারই ওঁর ব্যাপারে পড়েছি, কিংবা গল্প করেছি, মনে হয়েছে, তিনি অত্যন্ত শিশুসুলভ। একটা শিশুসুলভ সারল্য ওঁকে ঘিরে থাকত সারাক্ষণ…
উত্তর: সব গুণী শিল্পীরই তাই-ই হয়। মা-ও তাই ছিলেন।
প্রশ্ন: স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনীত দু’টি ছবি মুক্তির অপেক্ষায়। একটি ‘ধর্মযুদ্ধ’, অন্যটি ‘বেলাশুরু’।
উত্তর: প্রথমদিনের প্রথম শো দেখব। ধর্মযুদ্ধ দেখেওছি। রাজ (রাজ চক্রবর্তী) স্ক্রিনিং করেছিল।
প্রশ্ন: মঞ্চে মা, না পর্দায় মা, কোনটা বেশি ভাল?
উত্তর: দু’জায়গাতেই মা। এরকম খুব কম অভিনেতা হন, যাঁরা স্ক্রিন এবং স্টেজ, দু’জায়গাতেই খুব ভাল অভিনয় করেন। আমার মা সেটা পারতেন।
প্রশ্ন: একবার ফোনে কথা হচ্ছিল স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর সঙ্গে। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেনঃ আপনি সিরিয়ালে অভিনয় করছেন, সেটা তিনি একেবারেই চান না…
উত্তর: (হাসি) কিন্তু উনি আমার সিরিয়াল প্রত্যেকদিন দেখতেন এবং ভীষণ খুশি হতেন। যদিও আমি মনে করি উনি যা মনে করতেন, সেটা ভুল। কারণ, সিরিয়াল করে আমার যে আনন্দ হয়েছে… এখনও আমার যে আনন্দ হয়, বলে বোঝাতে পারব না। মা চলে যাওয়ার দুঃখটা ‘খড়কুটো’র ফ্লোর কমিয়ে দিয়েছে। ওটা আমার কাজের জায়গা, আমার একটা বাড়ি। স্কুল যেমন একটা জায়গা, ‘নান্দীকার’ একটা জায়গা, ঠিক তেমনই ‘খড়কুটো’র ফ্লোরও একটা জায়গা। এইটা মা-বাবার সঙ্গে আমার একটা বিরোধিতা। আমার মনে হয়, সমস্ত অভিনেতাদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে সমস্ত ফর্মে অভিনয় করা উচিত। এখানে আপনাকে জানিয়ে রাখি, মা আমাদের সিরিয়াল অভিনয় দেখতেন এবং আমার স্বামী ডিঙ্কা (সপ্তর্ষি মৌলিক)-র বিরাট ভক্ত ছিলেন। আসলে মায়ের একটা ভয় ছিল, তিনি মনে করতেন আমি টেলিভিশনে অভিনয় করতে গিয়ে ‘নান্দীকার’-এ অভিনয় করব না। সেটা আর কী করে বোঝাব বলুন…
‘মাধবী’ নাটকটি আজ, ১৯ নভেম্বর মঞ্চস্থ হতে চলেছে সোহিনী সেনগুপ্তর নির্দেশনায় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, দুপুর ৩টেয়। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন সোহিনী সেনগুপ্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও দেবশঙ্কর হালদার।
গ্র্যাফিক্স: অভীক দেবনাথ