শহরের কাগজ ফুলের গাছগুলোতে এখনও বসন্তের ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু প্রেমের মরশুম তো আর ক্যালেন্ডার দেখে আসে না! এই বছর যেমন মাঘেই কেটে গেল বসন্ত পঞ্চমী। আর রাত পোহালেই ভ্যালেন্টাইনস ডে, প্রেমের দিবস। তবুও আমরা বছরের যে কোনও সময় যে কোনও মানুষের প্রেমে পড়তে পারি।
এইটুকু জীবনে বেশ কয়েকটা মানুষের ওপর ক্রাশ খেয়েছি আমিও। তবে প্রেমটা একজনের সঙ্গেই হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়। প্রেম করলে হ্যাপি হরমোন বাড়ে। আর প্রেমে পড়লে? অ্যাড্রিনালিন থেকে ডোপামাইন সব কিছুই যেন ওলট-পালট হয়ে যায়। ফিরে তাকালে স্কুল লাইফের সেই ব্যর্থ প্রেমও আজ রঙিন লাগে। কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে যখন সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম এক ক্রাশের সঙ্গে, সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও হেসে ফেলি। আর সেই যে বাসে, একটা ছেলের ওপর ধুম করে ক্রাশ খেয়ে গিয়েছিলাম… আমার নামার কথা ছিল মিন্টো পার্কে, তার পিছু-পিছু একদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম সেক্টর ফাইভ। এরকম কত-কত স্মৃতি জমে আছে, যা প্রেমের মরশুমে হঠাৎ করেই হানা দেয়।
কিন্তু যত রোম্যান্টিক ভাবেই বিষয়টা উপস্থাপন করার চেষ্টা করিনা কেন, সত্যিটা হল এই যুগে ডেটিং অ্যাপ মানুষের সঙ্গে মেলামেশাকে অনেক সহজ করে তুলেছে। যদিও আমার একটা স্বভাব রয়েছে। একদম অপরিচিত একটা মানুষের সঙ্গে দু’দিন কথা বলার পরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। ‘কী রে কেমন আছিস’, ‘কী করছো’—এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই একটা ল্যাদ কাজ করে। তবুও ইচ্ছে হয় দিনের শেষে মনের কথাগুলো ব্যক্ত করার। তাই ডেটিং অ্যাপে প্রোফাইল তৈরি করতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল।
মানুষের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে। অনেকেই ভাবেন শুধু যৌনতার খোঁজে মানুষ টিন্ডার, বাম্বল-এর মত ডেটিং অ্যাপ জয়েন করেন। কিন্তু টিন্ডার জয়েন করার পর দেখলাম, বেশির ভাগ মানুষ ইনস্টাতে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করেন। আমার টিন্ডার জয়েন করার পিছনে আমার এক বন্ধুর বিশেষ অবদান রয়েছে। ও আমার অনেক আগে থেকে টিন্ডারে রয়েছে। ডেটেও গেছে এক-আধবার। ওর মত অন্তর্মুখী মানুষ যদি পারে, তাহলে একবার ট্রাই করে দেখাই যাক—এই ভাবনা থেকেই আমার টিন্ডার জয়েন করা।
শেষ অবধি একাকিত্বকে সঙ্গী করে দু’টো চারটে ছবি দিয়ে টিন্ডারের অন্দরমহলে পা রাখলাম। বায়োতে যথারীতি লিখলাম হবি, ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যাপটা বুঝে ওঠার আগেই দু’-চারটে রাইট-লেফট সোয়াইপ করে ফেলেছি। বেশ কয়েকটা ম্যাচও হল। একবেলা কথা হওয়ার পরই ইনস্টাতে ফলো-ফলোব্যাক চলল। অভ্যাসের দায়ে দু’দিন পর আমিও ইতি টানলাম কথোপকথনে।
এর মাঝে বহু রাতেই মনে পড়েছে প্রাক্তনের কথা। তবুও রাইট সোয়াইপ করেছি বহুজনকে। এরই মধ্যে ম্যাচ হল একটি ছেলের সঙ্গে (পরিচয় গোপন রাখা হল)। তার ছবিগুলো সবক’টাই পাহাড়ে তোলা। আর বায়োতে লেখা ছিল, ‘যদি সুযোগ পাও কেমন ধরনের ডেটে যেতে চাইবে তুমি’। আমি সেখানে রিপ্লাই দিয়েছিলাম, ‘পুদুচেরির বিচে হাঁটব আর সঙ্গে থাকবে বুড়ো সাধু’। শুরু হল হোয়াটস অ্যাপে চ্যাটিং।
কথা বলে জানতে পারলাম, আমার মত সে-ও পাহাড়প্রেমী। ট্রেক করে বেড়ায় হিমালয় জুড়ে। এর পাশাপাশি আমার মতো ওঁরও আগ্রহ আছে ওয়েব সিরিজ় দেখায়। বহুদিন পর কারোর সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগছিল। ট্যুর প্ল্যানিং, মিম শেয়ার থেকে শুরু করে ওয়েব সিরিজ়ের সাজেশন… সবই আদান-প্রদান হত। প্রায় এক বছর কথা বলার পর ডেটে যাই তাঁর সঙ্গে। দক্ষিণ কলকাতার এক নামজাদা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চে দেখা করি।
ডিসেম্বর মাস, তবু শহর জুড়ে বৃষ্টি। ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি দেশপ্রিয় পার্কের সামনে। প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করানোর পর তিনি এলেন এবং রেস্তোরাঁয় ঢুকে বললেন, তাঁর মুঘলাই খাবার ভাল লাগে না। আমারও ভাল লাগাটা ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবু সারা বিকেল একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম সাউথ সিটি মলের এ দোকান-ও দোকান করে। বাড়ি ফিরে যোগাযোগ বন্ধ করিনি। এখনও মিম শেয়ার, ওয়েব সিরিজ়ের সাজেশন সবই চলছে। তবে টিন্ডার ডেটের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছে সেই থেকে।
ডেটে যে রেস্তোরাঁতেই যেতে হবে, এটায় আমি কোনওদিন বিশ্বাসী ছিলাম না। দু’কাপ লেবু চা, ময়দানের কুয়াশা, গঙ্গার ঘাটে বসে একসঙ্গে সূর্যাস্ত দেখা, উত্তর কলকাতার অলি-গলি ঘোরা, কফি হাউজ়ের ইনফিউশনে আড্ডা, সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির সেই গা-ছমছম অনুভূতি… এই সব কিছুকেই যে ‘ডেট’ বলে চিনে এসেছি প্রথম থেকে। সুতরাং যথারীতি এই টিন্ডার ডেট খুব একটা মনের মত হয়নি। তবুও ডিসেম্বরের বৃষ্টিতে পরিচয় হয়েছিল এমন একটা মানুষের সঙ্গে, যে আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু শখগুলো এক থাকলেই মনের মিল হয় না।
টিন্ডার মানেই যে যৌনতা খুঁজছে কেউ, এই ধারণাটাও ভাঙতে পেরেছি আমি। এরপরও আমি ডেট করেছি আমারই এক পুরনো বন্ধুকে। যেহেতু ওই বন্ধুর টিন্ডারে আমার চাইতে অভিজ্ঞতা বেশি, তাই ময়দানে বসে মনের কথা শেয়ার করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। বেশ মাসখানেক এগিয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু তারপর দূরত্ব নিজে থেকেই তৈরি হয়ে যায়। যেহেতু কোনও টান ছিল না একে অপরের প্রতি, তাই ওর আর আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু টিন্ডারের কাছ থেকে আমি মুঘলাই ভাল না-লাগা এক ভাল বন্ধুকেও খুঁজে পেয়েছি।
আমার পরিচিত একজন বলেছিলেন: ডেটিং অ্যাপে নাকি বেশির ভাগ মানুষই নাকি ‘ফেক’ হয়। আমি মনে করি আমাদের সমস্ত ভার্চুয়াল দুনিয়াটাই আমরা নিজের মত করে সাজাই। ইনস্টা স্টোরি থেকে টিন্ডারের বায়ো সব কিছুই পিয়ার প্রেশারে তৈরি। তবে সেদিন ডেটে গিয়ে রেস্তোরাঁয় যে বন্ধুত্বটা গড়ে উঠেছিল, সেটার মধ্যে কোনও ভেজাল ছিল না।
প্রেমের দিনে এই সম্পর্কগুলোর কথা খুব একটা মনে পড়ে না। এই সম্পর্কগুলো খুব একটা দামী নয় আজ আমাদের কাছে। কিন্তু আজকের এই ডেটিং অ্যাপের দুনিয়ায় সবটাই যে যৌন চাহিদা, মানুষকে বোকা বানানোর জন্য করা হয়, এমনটা আগে থেকে ভেবে নেওয়া ভুল। বরং দিনের শেষে ভাল থাকাটা বেশি জরুরি। এর জন্য আপনি টিন্ডার থেকে রেস্তোরাঁয় ডেটে যাবেন নাকি সেই পুরনো মানুষটার বুকে মাথা গুঁজবেন, সবটাই আপনার সিদ্ধান্ত।
(ব্য়ক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত, মতামত একান্তভাবে ব্য়ক্তিগত)
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন: Valentine’s Day: ‘যে কোনও জন্তুকেই মানুষের থেকে বেশি বিশ্বাস করি’, বলছেন প্রাক্তন আরজে অয়ন্তিকা