Valentine’s Day: ‘টক-ঝাল-মিষ্টি লজেন্সের মতোই আমাদের সম্পর্কে ওঠানামা এসেছে’, এক দৃষ্টিহীন প্রেমিকের আত্মকথা

ভাঙা আয়না যেমন জোড়া লাগানো যায় না, কিংবা জোড়া লাগানো গেলেও দাগটুকু রয়ে যায় চিরকালের মতো। সেরকমই সম্পর্কে ঘুণ ধরলে সে সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যেতে গেলে প্রতিপদে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে ফুসফুস নিংড়ে।

Valentine's Day: 'টক-ঝাল-মিষ্টি লজেন্সের মতোই আমাদের সম্পর্কে ওঠানামা এসেছে', এক দৃষ্টিহীন প্রেমিকের আত্মকথা
Follow Us:
| Updated on: Feb 13, 2022 | 1:30 PM

ভালবাসা শব্দটা শুনলেই আমাদের প্রত্যেকের মনটা ভরে ওঠে। আট থেকে আশি ভালবাসার নামে সবকিছু করতে পারে। একজন সন্তানের কাছে তার মায়ের ভালবাসা যেরকম, ঠিক তেমনই ভালবাসা আগলে রাখে দু’টো মানুষকে। আমরা প্রত্যেকেই ভালবাসতে ভালোবাসি, তাই না? তাই এই ভালবাসার সপ্তাহে নিজের কাছের মানুষের সঙ্গে একটু সময় কাটালে মন্দ হয় না! সেটা যে সবসময় বিলাসবহুল কোথাও হতেই হবে তার কোনও মানে নেই। ফেব্রুয়ারি মাস হল ভালোবসার মাস। আর এই ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা পালন করছি ভালবাসার সপ্তাহ। যদিও অনেকেই বলবেন, ভালোবাসার কোনও সময় হয় না, তাই আসুন, আজ আমরা একটু অন্যরকম ভালোবাসার গল্প বলি।

প্রত্যেকের জীবনেই বসন্ত আসে, তেমনই আমার জীবনেও বসন্ত এসেছিল, তা-ও আবার ভালবাসার মাসেই। তখন সদ্য মাধ্যমিক দিয়ে একটা নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তখনও স্মার্টফোনের এত রমরমা ছিল না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বেশ কয়েকটা মাস কেটে গিয়েছে। দেখতে-দেখতে ভালবাসার মাস এসে হাজির হল। তখন আমাদের নব্বইয়ের দশকের ছেলেমেয়েদের ভরসা বিভিন্ন কোম্পানির এসএমএস প্যাক এবং ফোন কলস। ঠিক তেমনভাবেই রং নাম্বারে বেলা বোসের মতো আমার সঙ্গে আলাপ হল এক বন্ধুর। একথা সেকথায় বেশ কয়েকটা মাস কেটে যাওয়ার পর এরকম এক ভালবাসার মাসে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। সেইসব দিনের কথা মনে করলে আজ বেশ ভাল লাগে। মনে আছে, প্রথম সাক্ষাতেই আমরা গিয়েছিলাম মিলেনিয়াম পার্কে। বসন্তের সুন্দর আবহাওয়ায় কোকিলের ডাকের মতোই মিষ্টিমধুর কেটেছিল আমাদের দিনটা। এরপর আস্তে-আস্তে কথাবার্তা বাড়তে থাকল এবং আমার তার প্রতি কিছু একটা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু তৈরি হচ্ছিল সেটা বুঝতে পারছিলাম দু’জনেই। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, আমাদের প্রথম আলাপেই তাকে জানিয়েছিলাম, আমি দৃষ্টিহীন। আমি ছোটবেলা থেকে দৃষ্টিহীন হলেও আমার পরিবারের কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছিলাম, এই দৃষ্টিহীনতা বা এই প্রতিবন্ধকতাকে নিয়েই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই এ নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই, বরং এটা নিয়েই কীভাবে ভাল থাকা যায়, সে চেষ্টাই করতাম। আমার বন্ধুর তরফ থেকেও উত্তর এসেছিল, “তুমি তো একজন মানুষ, সেই মানুষটাকে সম্মান করলেই হবে।” ওই অল্পবয়সেও আমি আমার অনুভূতির কথা তাকে জানাই এক গ্রীষ্মের দুপুরে। তা-ও ফোনের মাধ্যমে। প্রথমে একটু কিন্তু-কিন্তু করলেও এক বর্ষার বিকেলে উত্তর এসেছিল, “অমিত আর লাবণ্যের মতোই আমাদের পথ চলাটা শুরু হল আজ।”

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে বসন্ত কখন আসবে, তা আমরা কেউই জানি না। আমরা দু’জনেই সেসময় উচ্চ-মাধ্যমিকের পড়ুয়া হওয়ায় খুব বেশি সাক্ষাৎ না হলেও কথা হত অনেকক্ষণ। একবার মহালয়ার আগের রাতে কী হয়েছিল, সে গল্পটা বলি। সে রাতে সারারাত কথা হয়েছিল। কোথা দিয়ে যে একটা রাত শুরু হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তা আজ ভাবলে বড্ড নস্টালজিক লাগে। তখন বিভিন্ন মোবাইল সিমের কোম্পানি তাদের বিভিন্ন অফার নিয়ে আসছে শহর এবং শহরতলিতে। প্রত্যেকটা ভালবাসার সম্পর্কে বিশ্বাস এবং বন্ধুত্ব সবার আগে প্রাধান্য পায়। আমাদের এই ভালবাসার সম্পর্কে দু’জনের অন্যতম ভাললাগা ছিল তৎকালীন খ্যাতনামা বাঙালি শিল্পীদের মৌলিক গান। রেডিও-টিভির পাশাপাশি ব্লুটুথের মাধ্যমে গান আদান-প্রদান করা ছিল আমাদের প্রতিটা সাক্ষাতের পর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

দেখতে-দেখতে পুজো চলে এল। আর পুজো মানেই প্রেম। এক সপ্তমীর সকালে উত্তর-দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুর দেখতে বেরলাম আমরা একসাথে। বাঙালির কাছে পুজোর প্রেমের মতো পুজোর খাওয়া-দাওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে লাঞ্চ সবটাই বাইরে করেছিলাম আমরা। ব্লু-কুর্তি আর ব্ল্যাক-জিন্সে বেশ লাগছিল ওকে। বাগবাজার থেকে শুরু করে দক্ষিণে সুরুচি সংঘ কিছুই বাদ পড়েনি সেই পুজো পরিক্রমাতে। সে দিন ব্রেকফাস্ট সেরেছিলাম উত্তর কলকাতার এক অতি প্রাচীন মিষ্টির দোকান থেকে। সেই দোকানের বৈশিষ্ট্য হল, কলাপাতায় পরিবেশন করা। সকালের মেনুতে ছিল কচুরি, ছোলার ডাল এবং ছানার জিলিপি। ওই দোকান কলকাতার ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আমাদের ভালবাসার সম্পর্কেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। উত্তর-দক্ষিণের ঠাকুর দেখার সঙ্গে-সঙ্গে টুকিটাকি খাওয়াদাওয়াও চলছিল। লাঞ্চ করেছিলাম দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো মণ্ডপের বাইরের দোকান থেকে। বাঙালি বিরিয়ানি ছাড়া দুর্গাপুজো ভাবতেই পারে না। তেমনই বিরিয়ানির আলু ছাড়া বাঙালির প্রেম অসম্ভব। সময় এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। ওকেও ফিরতে হত শ্রীরামপুর, আর আমাকে আমার বাড়িতে। তাই কলকাতার আর এক ঐতিহাসিক জায়গা, প্রিন্সেপ ঘাটে সূর্যাস্ত দেখতে-দেখতে দু’জনেই বাড়ির পথ ধরলাম। এভাবেই আমাদের সম্পর্কের সময় এবং আমরা এগিয়ে চলছিলাম। টক-ঝাল-মিষ্টি লজেন্সের মতোই আমাদের সম্পর্কে ওঠানামা এসেছে, সেই ওঠানামাগুলোকে আমরা একসঙ্গেই পার করেছি।

স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তির পালা এল এবার। আমাদের কলেজজীবন মানেই কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা এবং বাংলা ব্যান্ডের মধ্যে ক্যাকটাস, ফসিলস, চন্দ্রবিন্দু প্রভৃতি। জনপ্রিয় গানগুলোর পছন্দের লাইন লিখে পাঠানো ছিল আর একটা মজাদার ঘটনা। যাদবপুর টু শ্রীরামপুর করতাম বলে আমার বন্ধুরা মজা করে বলত, “আজও কি কলেজ শেষে শ্রীরামপুর?” এই শ্রীরামপুর কিন্তু রাজ্যের এক অন্যতম ঐতিহাসিক শহর। এ শহরের গঙ্গার ঘাটে আমরা ফেলে এসেছি কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। একটা দিনের কথা বলি। আমি মানুষটা বেশ দীর্ঘকায়। আমার উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে মানানসই হওয়ার চেষ্টায় সে একদিন হাই হিল পরে এল দেখা করতে। বরাবরের মতোই ঘাটের শেষ ধাপে বসে চলছে আমাদের প্রেমালাপ। হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হাইহিলের আশীর্বাদধন্যা হয়ে গঙ্গার জলে পড়ে গেল সে। আমি তাড়াতাড়ি করে তার হাত ধরে টেনে তুলে আনি। সে দিন তাকে বাড়ির রাস্তা অবধি পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরে এলাম, নিজেকে হিরো মনে হচ্ছিল। এখন অবশ্য সেসব স্মৃতিচারণ ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি ছাড়া আর কোনও অনুভূতি জাগায় না।

দেখতে-দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। প্রথমদিকে মাখো-মাখো ব্যাপার থাকলেও একটা সময়ের পর রোজকার অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়। আর যে কোনও মানুষই অভ্যেসের দাস। পুজো পেরিয়ে, ক্রিসমাস পেরিয়ে আবারও অনুপমের ভাষায় বলতে গেলে “বসন্ত এসে গেছে।” প্রত্যেকটা সম্পর্কের ভিত হচ্ছে বিশ্বাস। এবং এই বিশ্বাসটাই আমার পরস্পরের প্রতি বেশ ভাল ছিল। হঠাৎ এক বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে আমার ব্যস্ততার কারণে তাকে সময় দিতে পারছিলাম না। জীবনের গাড়ি সবসময় যে সোজাভাবে চলবে, তা কিন্তু নয়। তাই আমাদের প্রেমও আর পাঁচটা প্রেমের মতন খুনসুটি-ঝগড়ায় ভরে উঠত। সে বছর ভালবাসার সপ্তাহে আমরা গঙ্গাবক্ষে সেলিব্রেট করলাম আমাদের ভালবাসার এক বছর। আমার জীবনটা ছোটবেলা থেকেই ওঠানামার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। আমার প্রিয়তমা আমার হাত ধরার পর মনে হয়েছিল, দিনের শেষে আমারও একজন মানুষ আছে, যাকে সবকিছু শেয়ার করা যায়। এভাবেই দেখতে-দেখতে কয়েকমাস কেটে যাওয়ার পরেই আমার দ্বিতীয় সেমিস্টার চলে এল। পরীক্ষার চাপে আমাদের অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ হল না। তখন কীরকম যেন মনে হচ্ছিল, আমরা লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপে আছি। পরীক্ষা শেষ করে আমাদের আবার দেখা হল। এ শহরকে জানতে গেলে পায়ে হেঁটে না ঘুরলে প্রেমটা ঠিক পরিপূর্ণ হয় না। রাস্তার চায়ের দোকান থেকে মাল্টিপ্লেক্স – সমস্ত জায়গাতেই হাতে-হাত রেখে একটু-একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।

প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই একটা টার্নিং পয়েন্ট থাকে। এই টার্নিং পয়েন্টে এসে আমরা একটু ব্রেক নিলাম। আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই বকবক করতে ভালবাসি, তাই বললাম, “একটু ব্রেকের পরে ফিরে আসব।” হঠাৎ এক সকালে একটা ফোন কল পেলাম, “একদিন দেখা করতে পারবি? কিছু কথা আছে।” যথারীতি শ্রীরামপুরের ঘাটে দেখা হল আমাদের। হুগলির মিষ্টির মতোই আমাদের প্রেমটাও ছিল বেশ মিষ্টি। অনেকক্ষণ গল্প করার পর সে জানাল, আমাদের এই সম্পর্ক তার বাড়ি থেকে মেনে নিতে অস্বীকার করছে। তার পরিবারের বক্তব্য, একজন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেয়ে না রাখা অনেক ভাল। আমি প্রশ্ন করলাম, “তুইও কি তাইই মনে করিস?” উত্তর এল, “না।” এভাবেই সম্পর্কের তাল কাটতে শুরু করল। তখন একটি কমিউনিটি রেডিয়োতে কাজ করার সুবাদে রাতে আমাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল, কারণ আমার কাজটাই থাকত রাতে। ঠিক সেই সময়েই ওর এক বন্ধুর প্রতি ওর ভাললাগা তৈরি হচ্ছিল, তা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। একটা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুধুমাত্র আবেগের ওপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়া যায় না। বাস্তবের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে আমি রেডিয়োর পাশাপাশি বিভিন্ন ইভেন্টের কাজও করছিলাম। তখন থেকেই দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে। একটি কর্পোরেট ইভেন্ট সামলানোর জন্য হঠাৎই শ্রীরামপুর যেতে হল আমাকে। সেই ইভেন্ট শেষে ফেরার পথে আমি আর আমার বন্ধু দেখতে পাই ওকে, ওর বর্তমান ভালবাসার মানুষের সঙ্গে। তারপরেও আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুই এমন কিছু করেছিস কি?” উত্তর এসেছিল, “না।”

ভাঙা আয়না যেমন জোড়া লাগানো যায় না, কিংবা জোড়া লাগানো গেলেও দাগটুকু রয়ে যায় চিরকালের মতো। সেরকমই সম্পর্কে ঘুণ ধরলে সে সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যেতে গেলে প্রতিপদে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে ফুসফুস নিংড়ে। নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, আমাদের যেটুকু পথ একসঙ্গে চলার ছিল, সেই পথটুকু ফুরিয়ে গিয়েছে। ফেলে দেওয়া চায়ের ভাঁড়ের মতন সম্পর্কটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছি আমি, এগিয়ে গিয়েছে সে-ও।

ভালবাসা, মানুষকে ভাল থাকতে শেখায়। না-ই বা হল একসঙ্গে থাকা, দিনের শেষে যে যার মতন ভাল থাকাটুকুর জন্য আমরা কেউ-কেউ আজও নিজের অজান্তেই ভালবাসা খুঁজে চলি সম্ভবে-অসম্ভবে।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ

আরও পড়ুন: Valentine’s Day: টিন্ডার-প্রেম… App মুঝে অচ্ছে লগনে লগে