সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিশীলতায় কতটা ছিল ‘বাঘ মামা’? উত্তর দিলেন পুত্র সন্দীপ রায়
International Tiger Day: ১৯৭৪-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’। আর ১৯৭৮-এ দেশ-এই প্রকাশিত হয় ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর জন্য বাঘের ছবি দু’বার তোলা হয়েছিল। ‘হীরক রাজার দেশে’, মাদ্রাজের প্রসাদ স্টুডিয়োতে বিশেষ একটা সেট করা হল। সেখানে “পায়ে পড়ি বাঘ মামা” গানের দৃশ্যায়ন করা হয়। কর্মজীবনের শুরুতে সত্যজিৎ সিগনেট প্রেসের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’-এর প্রচ্ছদ যখন অলঙ্করণ করেন, তখন তা হয়ে ওঠে ওঁর জীবনের একটি অন্যতম বিখ্যাত কাজ।
নন্দন পাল: আজ ২৯ জুলাই, ইন্টারন্যাশনাল টাইগার ডে—বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস। জাতীয় পশু বাঘ নিয়ে আমাদের আগ্রহের অন্ত নেই। বাঘ এমন একটি বিষয় যা বারবার ফিরে এসেছে বাংলার সংস্কৃতিতে, লোকাচারে, সাহিত্যে, সিনেমায়। আর সাহিত্য, সিনেমা এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায় যাঁর অনায়াস বিচরণ, সেই উজ্জ্বল আন্তর্জাতিক বাঙালির জীবনে তাঁর কাজে কতটা ছিল দক্ষিণ রায়ের প্রতি আকর্ষণ? সত্যজিৎ রায়ের কথা বলছি। শতবর্ষের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আজ আমরা খোঁজ নেব সত্যজিতের সৃষ্টিশীলতায় কতবার, কীভাবে এসেছে শার্দূল? TV9 বাংলা বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস উপলক্ষ্যে কথা বলল ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’-র সৃষ্টিকর্তা সত্যজিৎ রায়ের পুত্র পরিচালক সন্দীপ রায়ের সঙ্গে।
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিশীলতায় ‘বাঘ’ বিষয় হিসাবে কেমন ছিল? বাবার একটা আকর্ষণ ছিল বাঘের প্রতি। মুগ্ধতাও বলা যেতে পারে। আশৈশব কেনেথ অ্যান্ডারসন কিংবা জিম করবেটের লেখা পড়ে বাবার সেই মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল। ওই দুই লেখকের বই ছিল তাঁর খুবই পছন্দের। সেই কারনেই সিগনেট প্রেসের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’-এর প্রচ্ছদ যখন অলঙ্করণ করেন, সেটি হয়ে ওঠে বাবার জীবনের একটি বিখ্যাত কাজ। ছোটবেলার সেই আকর্ষণ ওই কাজের সময়ে সাহায্যই করেছিল বাবাকে।
প্রসঙ্গত সত্যজিৎ তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে ডি জে কেইমার অ্যান্ড কোং-এ জুনিয়র ভিজ়ুয়ালাইজার হিসাবে যোগ দেন। দিলীপ কুমার গুপ্ত (‘ডিকে’ বলেই পরিচিত ছিলেন) ছিলেন সেখানকার অ্যাসিস্ট্য়ান্ট ম্যানেজার। দিলীপ কুমার গুপ্ত যখন ১৯৪৩ সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন, সত্যজিৎ রায় ডি জে কেইমার অ্যান্ড কোং ছেড়ে ডিকে-র সঙ্গেই সিগনেট প্রেসে যোগ দেন প্রিন্সিপ্যাল আর্টিস্ট হিসাবে। সিগনেট প্রেস থেকে ১৯৫০-এ প্রকাশিত হয় ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’। সত্যজিতের করা প্রচ্ছদ অলঙ্করণ আমূল পাল্টে দেয় বাংলা প্রচ্ছদের ইতিহাসের ধারা। মেটোনমিক অলঙ্করণে ওই প্রচ্ছদ হয়ে ওঠে বিখ্যাত। একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বোঝাতে মাত্র চারটে হলুদ কালো ডোরা কাটার দাগ দেখিয়েই প্রচ্ছদ এঁকে ফেলেন সত্যজিৎ। প্রচ্ছদের সামনের দিকে একটি বুলেট হোল, যাতে লেখা বই আর লেখকের নাম। আর প্রচ্ছদের পিছনের দিকে আর একটি অপেক্ষাকৃত বড় বুলেট হোল, সেখানে লেখক পরিচিতি। ঠিক যেমন শিকারির গুলি শিকারকে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে গেলে হয়।
সত্যজিতের সিনেমা আর সাহিত্যে বাঘ কতবার এসেছে? বাঘ কতবার এসেছে? (হাসি) সিনেমায় ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ আর ‘হীরক রাজার দেশে’। যদিও ‘হীরক রাজার দেশে’তে বাঘ নয়, ওটি বাঘিনী ছিল। আর বাবার সাহিত্যে বাঘ প্রথম এসেছে তারিণীখুড়োর গল্পে, তারপর ফেলুদার গল্পে। তারিণীখুড়োর গল্প ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’তে বাঘ এসেছে। তারপর ফেলুদার গল্প ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ আর ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’—এই দু’টি গল্পের প্লটেই বাঘ ছিল। বিশেষ করে ফেলুদার গল্প ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ লেখার আগে বাবা আবার নতুন করে কেনেথ অ্যান্ডারসন আর জিম করবেট পড়েছিলেন। বেশ কিছু বইও কিনেছিলেন। ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ পড়লে বোঝা যায় যে বাঘ নিয়ে ওই সময়ে তিনি একটা ‘ফ্রেশ’ পড়াশোনা করেছেন।
প্রসঙ্গত ১৯৭৪-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ আর ১৯৭৮-এ দেশ-এই প্রকাশিত হয় ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। তারিণীখুড়োর গল্পে বাঘ শিকারের আবহ। আর ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-এ বাঘ একেবারে সামনা সামনি। সেই গল্পে তোপসের বয়ানে আসলে সত্যজিতের বাঘ সম্পর্কে অনুভুতিগুলোই প্রকাশ পেয়েছে –ফেলুদা বলে “জানোয়ারের মতি-গতি বোঝা মানুষের চেয়ে অনেক সহজ, কারণ জানোয়ারের মন মানুষের মতো জট পাকানো নয়। মানুষের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি সাদাসিধে, তারও মন একটা বাঘের মনের চেয়ে অনেক বেশি প্যাঁচালো। তাই একজন অপরাধীকে শায়েস্তা করাটা বাঘ মারার চেয়ে কম কৃতিত্ব নয়।”
আর ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ সার্কাসের পালিয়ে যাওয়া বাঘকে ধরে আনার যে পটভূমি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে একবার তোপসে আর লালমোহন গাঙ্গুলি বাঘের মুখোমুখি হন। একেবারে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর ফ্রিজ় শটের মতোই বিবরণ। বাঘ সম্পর্কে সত্যজিতের মুগ্ধতা আবার উঠে এসেছে তোপসের বর্ণনায়- “আমার পা কাঁপতে শুরু করেছে, বুকের ভিতরে কে যেন হাতুড়ি পিটছে। অথচ আমার চোখ কিছুতেই বাঘের দিক থেকে সরছে না। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছি যে আমার ডান পাশে আবছা কালো জিনিসটা হচ্ছে লালমোহনবাবুর মাথা, আর সেটা ক্রমশ নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আন্দাজে বুঝলাম তাঁর পা অবশ হয়ে যাবার ফলে শরীরের ভর আর বইতে পারছে না। এটাও বুঝতে পারছিলাম যে আমার দৃষ্টিতে কী জানি গণ্ডগোল হচ্ছে, কারণ বাঘের আউটলাইনটা বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর গায়ের কালো ডোরাগুলো স্থির না থেকে ভাইব্রেট করছে।”
ফিল্মের শুটিংয়ে বাঘ নিয়ে কাজ করা তখনকার সময়ে কতটা কঠিন ছিল? সেই সময়ে বাঘ এবং অন্য পশু নিয়ে সিনেমায় কাজ করা যেত। এখন আর তা করা যায় না। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর জন্য বাঘের ছবি দু’বার তোলা হয়েছিল। প্রথমে শুটিং হয় বীরভূমে। সেই ছবি ‘আন্ডার এক্সপোজ়ড’ হয়ে যায়। তা-ই আবার বাঘের ছবি তোলা হয়। দ্বিতীয় বার উনি বোড়ালের ‘পথের পাঁচালি’র গ্রামে ফিরে গেলেন। সেখানকার বাঁশ বনে দ্বিতীয়বার শুট করা হয় বাঘের দৃশ্য। তারপরে ‘হীরক রাজার দেশে’, মাদ্রাজের প্রসাদ স্টুডিয়োতে বিশেষ একটা সেট করা হল। সেখানে “পায়ে পড়ি বাঘ মামা” গানের দৃশ্যায়ন করা হয়। বাইরে থেকে একটা টানেলের মতো করা হয়েছিল। সেই টানেল দিয়ে বাঘ সেটে আসা-যাওয়া করত। সেই বাঘটি সত্যজিতকে দিয়েছিলেন টাইগার গোবিন্দরাজ বলে এক বিখ্যাত ব্যক্তি।
পায়ে পড়ি বাঘ মামা কোরো না কো রাগ মামা তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত ?
এ যে বিনা মেঘে পড়ে বাজ কেঁচে বুঝি গেল কাজ দয়া করে থাকো হয়ে শান্ত!
যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা কী হবে তা জানি বাবা হারা যাবে তাজা দুটি প্রাণ তো ! তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত?
বাঘাদা, বলি হীরা নিলে কত শুনি? সময় কী আছে যে গুনি? তবু, কত শুনি? নিয়েছি যথেষ্ট।
তবে আর নিয়ে কাম নাই এবারে চল পালাই বড় কষ্টে পাওয়া গেছে কেষ্ট! যথেষ্ট যথেষ্ট।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।
আরও পড়ুন, “জঙ্গল এখন আইল্যান্ড হয়ে গিয়েছে, বাঘের বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যা বড় সমস্যা”