“জঙ্গল এখন আইল্যান্ড হয়ে গিয়েছে, বাঘের বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যা বড় সমস্যা,” বললেন সাফারি অর্গানাইজ়ার-ব্যাঘ্রপ্রেমী তমানুদ মিত্র
International Tiger Day: তমনুদ মিত্র। পেশাদার পরিচয় সাফারি অর্গানাইজ়ার তথা তথ্যচিত্র নির্মাণে সাহায্য করেন। এক সময় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ছিলেন। কিন্তু নেশা ছিল বাঘ। ২০১২ থেকে পেশা এবং নেশা এক হয়েছে। এই বিশেষ দিনে বাঘ নিয়ে সাধারণ মানুষের ঠিক কী-কী জানার প্রয়োজন? তমানুদের একটি বাক্যে উত্তর, “বাঘের ব্যাপারে জানার শেষ নেই।”
ইন্টারন্যাশনাল টাইগার ডে। ২৯ জুলাই, ক্যালেন্ডারে দিনটা এ ভাবেই পালিত হয়। কিন্তু তার বাইরেও তো বাঘ নিয়ে অনেক কিছু জানার রয়েছে। ঠিক যেমন তমনুদ মিত্র। পেশাদার পরিচয় সাফারি অর্গানাইজ়ার তথা ব্যাঘ্রপ্রেমী। এক সময় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ছিলেন। কিন্তু নেশা ছিল বাঘ। ২০১২ থেকে পেশা এবং নেশা এক হয়েছে। এই বিশেষ দিনে বাঘ নিয়ে সাধারণ মানুষের ঠিক কী-কী জানার প্রয়োজন? ফোনে এই প্রশ্ন করতে, তমানুদের একটি বাক্যে উত্তর, “বাঘের ব্যাপারে জানার শেষ নেই।” সত্যিই হয়তো এই আলোচনায় আরও অনেক কিছু জানার বাকি থাকবে। কিন্তু তথ্যচিত্র তৈরি (BBC Big Cats – Behind the Scenes of Swamp tiger in Sunderbans তথ্য়চিত্র নির্মাণে সাহায্য করেছেন তমানুদ, যে তথ্য়চিত্রে রয়েছে সুন্দরবনে বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা।) বা সাফারি করানোর পাশাপাশি তমানুদ বাঘ নিয়ে যা জেনেছেন, যতটা সম্ভব স্বল্প পরিসরে সাধারণের বোঝার মতো করে জাতীয় পশুর বিষয়ে বিভিন্ন অজানা তথ্য শেয়ার করলেন।
খাঁচার বাঘ, আর বনের বাঘের খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিস্তর ফারাক। অধিকাংশ মানুষের এখনও চিড়িয়াখানাতেই বাঘ দেখে অভ্যস্ত। জঙ্গল সাফারির সুযোগ তো সকলে পান না। আপনি বিষয়টা কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বাঘ এমন একটা প্রাণী যতক্ষণ না কেউ জঙ্গলে গিয়ে দেখছেন, ততক্ষণ তার যে ক্যারিশ্মা, যে অরা, সেটা বোঝা যাবে না। বেশ কয়েক কিলোমিটার যার রাজত্ব, তাকে খাঁচার মধ্যে রেখে বোঝা যায় না। ফ্রিডমটা জঙ্গলের বাঘকে না দেখলে বোঝা মুশকিল।
ভারতে এখন বাঘের সংখ্যা কত?
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারতে বাঘের সংখ্যা ব্যাঘ্রসুমারি অনুযায়ী প্রায় ৩০০০-এর বেশি। বেঙ্গল টাইগার। আমাদের দেশ কিন্তু জঙ্গলে বাঘ দেখার জন্য সবথেকে আইডিয়াল।
কোনও জঙ্গলে বাঘ থাকলে সেটা পরিবেশগত দিক থেকে কতটা ভাল?
বাঘের কথা জানলে, পড়াশোনা করলে দেখবেন, ইতিহাসেও লেখা রয়েছে, যে জঙ্গলে বাঘ রয়েছে, সেই জঙ্গলের ইকো সিস্টেম ভাল। বাঘের সংখ্যা বাড়লে তার নীচের বাস্তুতন্ত্রও ঠিকঠাক চলবে। অন্তত জঙ্গলের দিক থেকে ভাল।
বাঘ থাকার জন্য উপযুক্ত যে সব জঙ্গল, সেখানে কোন-কোন জিনিস অবশ্যই থাকে? অথবা টাইগার কনজারভেশনের কথা রাষ্ট্রীয় স্তরে যখন ভাবনাচিন্তা হয়, সেক্ষেত্রে কোন-কোন বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়?
টাইগার কনজারভেশনের জন্য প্রথম দরকার ফুড অ্যান্ড ওয়াটার। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং জল। সাধারণত চিতল হরিণ যেগুলো দেখি আমরা, বছরে গড়ে একটি বাঘের চিতল হরিণ ৪০-৫০টি প্রয়োজন। তবে খাবারের প্রয়োজন মেটে। দ্বিতীয়ত, সেফ শেল্টার। শিকার করার জন্য ভাল ঘাস। এমন ভেজিটেশন যেখানে লুকিয়ে থেকে বাঘ শিকার করতে পারবে। বাঘ কিন্তু সারপ্রাইজ অ্যাটাক করে। আচমকা শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাঘ লুকিয়ে থাকে। শেষ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই লুকনোর মতো ঘাস চাই। আর সঙ্গী চাই। জেনারেশন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক সঙ্গী প্রয়োজন। এটা যদিও খুবই জেনারালাইজড কথা। তবে এইগুলো থাকলে তবেই বাঘ বাঁচবে।
জঙ্গলে সাধারণত কতটা এলাকা নিয়ে বাঘ থাকে?
বাঘের বিশাল জায়গা দরকার। ২৫ স্কোয়ার কিলোমিটার থেকে ১০০ স্কোয়ার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পপুলেশনের জন্য জঙ্গলের অংশ কমে যাচ্ছে। যে সব জায়গায় এখনও বাঘ আছে, সেখানকার বিভিন্ন জঙ্গল কী ভাবে কানেক্ট করতে পারি, সেটা আমাদের দেখতে হবে। জঙ্গলের চারিদিকে মানুষের বসতি। ফলে জঙ্গল এখন আইল্যান্ড হয়ে গিয়েছে। বাঘের বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সমস্যা।
কেন?
একই জঙ্গলের বাঘ মিলন করে পরের জেনারেশন তৈরি হচ্ছে। এতে একই জিনের দু’টি বাঘের মিলনের সম্ভবনা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে যদি কখনও ওই জিনের কোনও রোগ হয়, জিনগত সমস্যা দেখা দেয়, তা হলে একই রোগে সব বাঘ একসঙ্গে মরে যাবে। এই কারণেই গির অরণ্যের সিংহ নিয়ে সকলে এত ভয় পায়।
লোকালয় পেরিয়ে বাঘ অন্য জঙ্গলে যায় না?
অবশ্যই যায়। রাতের অন্ধকারে লোকালয় ক্রস করে এক জঙ্গল করে আর এক জঙ্গলে চলে যাচ্ছে বাঘ। গত পাঁচ, ছয় বছরে ২০০, ৩০০, ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে বাঘ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চলে গিয়েছে সে নজিরও রয়েছে। নাগপুরের আশপাশের জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা এত বেশি, ওখানকার বাঘ সব সময় নতুন জায়গা খোঁজে। লোকালয় তৈরি হওয়ায় ওদের এক জঙ্গল থেকে আর এক জঙ্গলে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়েছে।
বসতি পেরিয়ে জঙ্গলে যাওয়ার সময়ই কি লোকালয়ে হানা দেয় বাঘ?
একেবারেই না। জঙ্গলে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে লোকালয়ে আসে। জঙ্গল কমে গিয়েছে বলেই বাঘ বাইরে চলে আসছে আর হিউম্যান-অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট হচ্ছে। আবার যে বাঘ মানুষকে অ্যাভয়েড করতে চায়, সে সামনে আসেই না। আমার মনে হয়েছে, জঙ্গলের প্রোডিউসকে মানুষ যখন কর্মাশিয়াল প্রয়োজনে ব্যবহার করছে, তখন জঙ্গলের উপর চাপ পড়েছে। জঙ্গলের কোনও ফল বা অন্য কিছু যেটা হয়তো বাঁদরের খাওয়ার কথা, মানুষ বেচে দিচ্ছে। ফলে বাঁদর খেতে পারছে না। সবটাই তো চেইন সিস্টেম। পরোক্ষে এই ঘটনা বাঘকেও এফেক্ট করছে। বাস্তুতন্ত্রে চাপ পড়ছে। তাই এমন কিছু করতে হবে, যাতে জঙ্গল লাগোয়া বসতি যাঁদের তাঁদের রোজগার জঙ্গলের উপর নির্ভর করবে না। ধরা যাক, ট্য়ুরিজ়ম। এতে লোকাল কমিউনিটির আর্নিং থাকে। তখন শুধুমাত্র জঙ্গলের উপর নির্ভর করে বাঁচতে হয় না। ফরেস্ট প্রোডিউসের উপর থেকে মানুষের ডিপেন্ডেসি কমলে আখেরে সবার ভাল।
বাঘ নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও ভুল ধারণা ভেঙে দিতে চাইবেন?
বাঘ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। দু’টো খুব কমন ধারণা, যেটা আমরা বইতে পড়ি, বা লোকমুখে শুনি, তার কথা বলব। আসলে বুকিশ নলেজ নয়। ইন্টারনেট ঘাঁটলে বাঘের ব্যাপারে প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু তা সব সময় সঠিক নয়। ধরুন, বাঘ খুব হিংস্র প্রাণী। এটা ভুল ধারণা। কলকাতায় থেকে জঙ্গলের ব্যপারটা বোঝা যাবে না। বান্ধবগড়ে (মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল এলাকা, যে জঙ্গল বাঘের জন্য বিখ্যাত) ১০টা দিন থাকলে, আশপাশের গ্রামের লোকের সঙ্গে কথা বললে জানবেন, এলাকার মানুষ পায়ে হেঁটে ফেরার সময়, সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে বাঘ দেখেছেন। জঙ্গলে যান স্থানীয় লোক। জঙ্গলের লাগোয়া অংশেও বাঘ আছে। তেন্দু গাছ, যা থেকে বিড়ির পাতা তৈরি হয়। সেটা তুলতে যান। মহুয়া ফুল তুলতে যান। বাঘের খুব কাছাকাছি আসেন ওঁরা। করবেট বা কাজিরাঙাতেও তাই। কিন্তু বাঘ তো তাঁদের অ্যাটাক করে না। আসলে বাঘের পেট ভর্তি থাকলে হেঁটে চলে যাবে, ঘুরেও দেখবে না। খিদে পেলে বা বাঘিনীর বাচ্চাকে খাওয়ানোর প্রয়োজন যখন, সে সব সময় শিকার করে।
আর দ্বিতীয় ভুল ধারণা?
কোনও বাঘ যদি রক্তের স্বাগ পেয়ে যায়, সে নাকি ভয়ানক হিংস্র হয়ে যায়, প্রচলিত কথা আছে। এটাও ঠিক নয়। জিম করবেটের বইতে আছে, একটি বাঘিনী, তার বাচ্চারা তখনও বড় হয়নি, মানুষ মেরেছিল। ম্যান ইটার হয়ে গিয়েছিল। মানুষের রক্তের স্বাদ সে নিজে পেয়েছিল। তার বাচ্চারাও পেয়েছিল। জিম করবেট সেই বাঘিনীকে মেরে ফেলেন। পরে বাচ্চাগুলো কিন্তু মানুষ মারত না। অথচ মা বেঁচে থাকাকালীন নিজের বাচ্চাদের মানুষ মেরে মাংস খাইয়েছিল। ফলে বাচ্চাগুলো কিন্তু মা বেঁচে থাকাকালীন মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছিল। ওই প্রচলিত ধারণা যদি সত্যিই হত, তা হলে বাচ্চাগুলো বড় হওয়ার পর, শিকার করতে শুরু করার পর, তাদেরও মানুষ মারা উচিত ছিল। তা তো হয়নি। ফলে বই পড়া জ্ঞান নিয়ে বাঘকে জানা সম্ভব নয়। আমি তো বলব, এই সব স্পেশ্যাল ডে সেলিব্রেশনে বাঘ সম্বন্ধে পড়াশোনা করা, জানার আরও আগ্রহ তৈরি হোক সকলের মধ্যে। কারণ আমার দেখা সবথেকে ম্যাজিক্যাল অ্যানিম্যাল বাঘ।
ম্যাজিক্যাল শব্দটা ব্যবহার করলেন কেন?
ম্যাজিক্যাল তো আমরা তাকেই বলি, এমন একটা জিনিস যা দেখে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি, পরিবেশ পাল্টে দিচ্ছে এমন কিছু, সেটাই তো ম্যাজিক। বাঘ দেখতে পেলে হরিণ, বাঁদরের মতো প্রাণী অ্যালার্ম কল বা ওয়ার্নিং কল দেয়। লেপার্ডকে দেখলেও দেয়। আমি নিজে দেখেছি, বাঘিনি হেঁটে আসছে। আমাদের জিপসি ব্যাক করছে। গাছের উপর হনুমান বসে রয়েছে। কিন্তু আওয়াজ করছে না। কেন যে অ্যালার্ম কল দিল না, অর্থাৎ ডাকল না, জানি না। কারণটা জানি না বলেই হয়তো বাঘ ম্যাজিক্যাল।
এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই তমনুদ মিত্রের তোলা।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন, সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিশীলতায় কতটা ছিল ‘বাঘ মামা’? উত্তর দিলেন পুত্র সন্দীপ রায়