প্রীতম দে
‘এ ঢিপি তো ঢিপি নয়, ইতিহাস নিশ্চয়।’ রাজার ঐশ্বর্য মিশে আছে সে ঢিবিতে। সোনা-দানা গুপ্তধনের থেকেও দামি ঐতিহাসিক নিদর্শন।
আউশগ্রামের রামনগরে পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে সংরক্ষণশালা তৈরির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে ‘পাণ্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র’। সংগঠনের তরফ থেকে রাজ্যের কলকাতায় সিজিও কম্পেলেক্সের পুরাতত্ত্ব বিভাগসহ দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পাণ্ডুরাজার ঢিবির দায়িত্বে থাকা কালনা অফিসের সিও-র কাছেও অভিযোগ করেছেন। সংগঠনের সম্পাদক, লেখক রাধামাধব মণ্ডল বলেন, ‘‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। আমরা পথে আছি, দীর্ঘ লড়াই হবে প্রাগৈতিহাসিক এই সভ্যতার ঢিবির ইতিহাসকে সামনে আনতে। ভারতবর্ষের ইতিহাস বদলে যাবে, এখানকার সমস্ত তথ্য সামনে এলে। পুরাতত্ত্ব বিভাগের বিরুদ্ধে এই লড়াই চলছে, চলবে।’’ শুধু তাই-ই, নয় গোটা দেশে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে, সোশ্যাল মিডিয়াতে সাহায্যের জন্য আবেদনও করেছেন সংগঠনের সম্পাদক গবেষক রাধামাধব মণ্ডল।
‘পাণ্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র’-র দাবিতেই ইতিমধ্যেই নড়েচড়ে বসেছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ। সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীন এই ইতিহাসক্ষেত্রটি বাঁচানোই সংগঠনের লক্ষ্য। সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হলে ভারতবর্ষের ইতিহাস বদলে যাবে বলে দাবি বহু গবেষকের। বর্ধমানের পুরাতত্ত্ব বিভাগের কর্মী আব্দুল মালেককে পাঠিয়েছে কালনা পুরাতত্ত্ব বিভাগ, যাতে পাণ্ডুরাজার ঢিবির সংরক্ষিত এলাকাতে আগাছা নিধন-সহ এলাকা পরীক্ষা করে আসা হয়। দায়িত্বে থাকা কালনা অফিসের সিও গঙ্গাধর দাস–তারাও মানছেন এই ইতিহাসক্ষেত্রের এই ভগ্ন অবস্থার কথা। হারাতে বসেছে বাঙলা ও বাঙালির ইতিহাসের প্রাচীনত্বের গৌরব। ড. তমাল দাশগুপ্তের মতো বহু দেশ-বিদেশের গবেষক পাণ্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্রের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই লড়াই এবার দিল্লিতেও হবে।
পাণ্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্রের দাবি, বৃহত্তর লড়াই শুরুর আগেই, খবর পেয়ে দায়সারা পরিষ্কার করতে শুরু করল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ বৃহস্পতিবার সকালে। এই কর্মসূচি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন গবেষকরা। যদিও গবেষণা কেন্দ্রের সম্পাদক রাধামাধববাবু বলেন, ‘‘ঘাস কেটে কি হবে? কেন এই দায়সারা কাজ? আমাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা? জবাব চাইছি। চলবে লড়াইও। এবার আমরা বৃহত্তর লড়াইয়ের পথে হাঁটব। দেখি আর কতদিন, নীরব থাকে ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ।’’
পাণ্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্রের দাবি, সংরক্ষিত স্থানটিতেই সংরক্ষণশালা করতে হবে। আগের মতো সর্বক্ষণের রক্ষী রাখতে হবে, তা না হলে চুরি হচ্ছে ইতিহাস বস্তু। ইতিহাসক্ষেত্রটির সঠিক সংরক্ষণ জরুরি এবং পুনরায় খনন করতে হবে। ৮৫% স্থানে খনন হয়নি, খনন রিপোর্ট অনুযায়ী।
পুরাতত্ত্ববিদ পরেশনাথ দাশগুপ্তের খনন রিপোর্ট অনুযায়ী সমস্ত উদ্ধার হওয়া প্রত্নবস্তু একত্রে এনে পাণ্ডুরাজা সংরক্ষণশালা নির্মাণ করে রাখতে হবে, ইতিহাসক্ষেত্রটির কাছেই। রক্ষী ঘর, বাথরুম, গেস্ট হাউস করতে হবে। বেড়া, দেওয়াল, তার কাঁটা, পুরোনো বোর্ড সবই ভেঙ্গেছে। মেরামত নেই দীর্ঘ দিন। সংরক্ষিত ক্ষেত্রের উপরে এবং চারদিকে লাইট পোস্ট করতে হবে। এই সব দাবিগুলো লিখেই অভিযোগ করা হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে। সংগঠনের পক্ষ থেকে পাণ্ডুরাজা উৎসব করা হয় প্রতি বছর। যদিও দীর্ঘ করোনাকালে দু’বছর বন্ধ রয়েছে এই উৎসব বলে জানা যায়। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগরের পাণ্ডুকের রসফাল্লা পুকুরপাড়ের এই রাজা পোঁতার ডাঙায়, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৫ এবং শেষ ১৯৮৫তে খননকার্য চালায়। বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ পরেশনাথ দাশগুপ্ত, ড দেবকুমার চক্রবর্তী, শ্যামচাঁদ মুখোপাধ্যায়রা ছাড়াও সে সময়ের এশিয়ার বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ ওয়াই ডি শর্মা, হংসলাল ধীরাজলাল শঙ্খলিয়া, ড. বি বি লাল-রা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রত্নবস্তু উদ্ধার হয়েছে। একই স্থানে পাঁচটি সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, এই প্রত্নক্ষেত্রে ধাতব শিলালেখ, হাতির দাঁতের বিভিন্ন বস্তু-সহ ১১টি করোটি বিহীন মানব সমাধি, পাত্র সমাধি, শৃঙ্খ বিহীন কার্তেকীয় মূর্তি, প্রাগৈতিহাসিক পর্বের কিছু নমুনাও বিজ্ঞানীদের অবাক করে।
পাণ্ডুরাজার ঢিবির দায়িত্বে থাকা কালনা পুরাতত্ত্ব বিভাগের কনজারভেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট গঙ্গাধর দাসের দাবি, ‘‘স্থানীয় আবেদনের বিষয়টি বারবার আমরা কলকাতার সিজিও কমপ্লেক্সে পুরাতত্ত্ব বিভাগকে জানিয়েছি। এর বাইরে আমাদের কোনও ক্ষমতা নেই।’’