মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন বলিউডের পরিচালক তথা প্রযোজক রাজ কুশল। ব্যক্তিগত সম্পর্কে যিনি ছিলেন অভিনেত্রী তথা সঞ্চালিকা মন্দিরা বেদীর স্বামী। রাজের মৃত্যুর পর শেষযাত্রায় সঙ্গী ছিলেন মন্দিরা। আক্ষরিক অর্থেই জীবনসঙ্গীর দেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শ্মশানের যাবতীয় নিয়ম পালন করেছেন মন্দিরাই। আমাদের সামাজিক কাঠামোয় প্রিয়জনের মৃত্যুর পর শ্মশানযাত্রা এবং নিয়ম পালন সাধারণত পুরুষদের করতেই দেখা যায়। রাজ-মন্দিরার ছেলে নাবালক। সে এই কাজ করেনি। ফলে মন্দিরার এই কাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। এই কাজ কি পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ? ছকভাঙা উদাহরণ তৈরি করলেন মন্দিরা? নাকি দৈনন্দিনের এমন বহু কাজ রয়েছে, যাতে পুরুষ আধিপত্য থাকলেও মেয়েরা অনায়াসে করে ফেলেন, এ তেমনই উদাহরণ? ব্যখ্যা করলেন মানবাধিকার কর্মী শাশ্বতী ঘোষ।
ইংরেজিতে যিনি কফিন বহন করেন, তাঁকে পল বেয়ারার বলে। বাংলা বা সংস্কৃতে যাঁরা শববাহী, তাঁদের সম্বোধনে আলাদা কোনও শব্দ আছে কি না, আমি জানি না। একজনের শেষকৃত্য, অর্থাৎ দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আগুনে সমর্পণ অথবা কবর দেওয়া হতে পারে খ্রিষ্টান বা ইসলাম পদ্ধতি অবলম্বন করে অথবা পার্সিদের মতে, যেখানে পাখিরা এসে খেয়ে যাবে শবদেহকে সেখানে ফেলা হতে পারে, এই কাজের পর্যায়টা প্রকাশ্য একটা পর্যায়। এটা গোপনে করা হয় না। মৃত্যুতে অপরাধের উপাদান না থাকলে, এটা প্রকাশ্যেই করা হয়। চার দেওয়ালে মধ্যে যে কাজ, তার দৃশ্যমানতা যতটা, এই কাজের দৃশ্যমানতা তার তুলনায় অনেক বেশি।
এ বার রাজ কুশলের মৃত্যুর পরবর্তী ধাপে মন্দিরা বেদী স্ত্রী হিসেবে স্বামীর শেষকৃত্যের যে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটার কথা যদি বলি, এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হওয়াই স্বাভাবিক। রাজ নিজে বিজ্ঞাপন জগতের মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগত নিরিখে তিনি মন্দিরার স্বামী। ফলে এই ঘটনা মিডিয়ায় উঠে আসবে, সেটা প্রত্যাশিত। আবার মন্দিরার কাজটা তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক ধারণার থেকে আলাদা। সে দিক থেকে দেখলে মন্দিরা প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে কাজ করে হয়তো চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। হয়তো বা নয়।
মন্দিরার আগের কাজগুলো যদি একটু দেখা যায়, তা হলে স্পষ্ট উনি ছকভাঙা কাজ আগেও করেছেন। এটাই প্রথমবার নয়। মন্দিরা যখন কমেন্ট্রি করতে শুরু করলেন, তখন কিন্তু আইপিএল-এর এত রমরমা ছিল না। মহিলা কমেনট্রেটর হিসেবে তিনি ছক ভেঙেছেন। আবার ট্রাক নিয়ে একা হাতে ড্রাইভ করে লাদাখ যাওয়া, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে যেটার ১০ পর্বের সিরিজ আছে ওঁর। সেটাও তো অন্য রকমের কাজ। চেনা ছকের বাইরে। ফলে মন্দিরা সব সময়ই একজন ছক ভাঙা মহিলা। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য পালন কতটা গণমাধ্যমের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য, আর কতটা মনের বিশ্বাস থেকে, তা বলা কঠিন। এ কথা ঠিক, মন্দিরার অন্যান্য কাজ দেখলেই বোঝা যাবে, কোথাও তিনি ছক ভাঙতেই পছন্দ করেন। রাজ মন্দিরার প্রিয়জন, স্বামী, দীর্ঘদিনের বন্ধু। তিনি চলে যাচ্ছেন, সেই শোকের মুহূর্তে মন্দিরা যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রশংসা করি।
আজও শববাহকদের মধ্যে মেয়েদের পাওয়া যায় না। অথবা খুব কম পাওয়া যায়। মেয়েরা মুখে আগুন দিলে সেটাই সংবাদ হয়। ফলে নিঃসন্দেহে মন্দিরার এই কাজের মধ্যে ছকভাঙা উপাদান আছে। এই কাজটা যে মেয়ে করতে পারেন, তাঁর খুব মনের জোর থাকা দরকার। তাঁকে সমর্থন করার ভিত্তিটাও দৃঢ় হওয়া দরকার। অত্যন্ত শোকের মুহূর্তে অত্যন্ত নিকটজন চলে গিয়েছেন, সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয়।
মন্দিরাকে দেখে ভবিষ্যতে হয়তো অনেকে এগিয়ে আসবেন। একজন মেয়ে পুরোহিত হলে, অন্যরাও হচ্ছে। একজন মহিলা নামাজ পড়াচ্ছেন যখন, তাঁকে দেখে অনেকে ইচ্ছেপূরণ করছেন। একজন মহিলা কাজী হলে, বাকিরাও বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে এগিয়ে আসছেন, কাজী হওয়ার জন্য। তাই মন্দিরার এই কাজ অনেক মেয়েকেই হয়তো এগিয়ে দেবে।
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
আরও পড়ুন, সম্ভব হলে প্রিয়জনের শেষকৃত্যের নিয়ম পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে প্রত্যেকের পালন করা উচিত: সুজিত সরখেল